বিলেতে নির্বাচনের আগে নেতাদের পুরোমাত্রায় খসড়া দিতে হয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহণের মতো প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন কীভাবে বাস্তবায়িত করবেন। আমাদের দেশের নির্বাচন প্রস্তুতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এই গা-ছাড়া মনোভাবের সুযোগ নিয়েই নেতাদের ভোট জেতার অ্যাজেন্ডা তৈরি হয়– আমরা তা ‘ফলো’ করি মাত্র। লিখছেন ইন্দ্রজিৎ রায়।
নির্বাচনের দামামা শুধু আমাদের দেশেই যে বেজেছে, তা নয়; পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দেশও তার নতুন নেতা বেছে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে এ-বছরই। বিলেতে এখনও দিনক্ষণ স্থির না হলেও ধরে নেওয়া হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেবেন; আর, চার বছর অন্তর-অন্তর নভেম্বরের গোড়ায় তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন বঁাধা-ই থাকে।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেই যুযুধান মূলত দুই পক্ষ। ব্রিটেনে, একাধিক দল থাকলেও, ভোটে কনজারভেটিভ বা টোরি দলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের মুখোমুখি বিরোধী লেবার দলের নেতা কিয়র স্টার্মার; আমেরিকাতে চার বছর আগের লড়াইয়ের পুনরাবৃত্তি– ডেমোক্র্যাট বাইডেন বনাম রিপাবলিকান ট্রাম্প। তুলনায়, আমাদের দেশে মোদির বিরুদ্ধে কংগ্রেস-সহ বহু আঞ্চলিক দল। আমেরিকা বা বিলেতের সঙ্গে আমাদের তফাত অবশ্য নানা ক্ষেত্রে। উন্নত দেশে অযৌক্তিক ভাবাবেগে নাগরিকের মন বা ভোট কোনওটাই জয় করা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ট্রাম্প ফেরত আসছেন ব্যক্তিপুজোর কল্যাণেই অথবা বিলেতে কনজারভেটিভরা যা-ই নীতি আনুক, লেবারের চোদ্দো বছরের বনবাস শেষ এবার হবেই। বাস্তবে ঠিক তার উল্টো। বিলেতে ‘কনজারভেটিভ তো অনেক দেখলাম, এবার লেবার আনো’– এই জাতীয় ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্ট’ বা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ন্যাকা সেন্টিমেন্ট চলে না।
বিলেতের সাধারণ নাগরিক চায় তাদের জীবনে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহণের মতো প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি; বিদেশনীতি, অভিবাসনের মতো বিষয়ে দলীয় আস্থাযোগ্য মতাদর্শ। লেবার দলের নেতাকে তাই প্রতিপদে জবাবদিহি করতে হচ্ছে, ক্ষমতায় এলে তঁার দল কী-কী করবে। ভোটদাতারা বিলক্ষণ জানে তারা কী চায়, তাই নেতাদের কাজ সেইমতো দলের নীতি স্থির করা। পলিটিক্যাল ইকোনমির পরিভাষায় বললে, পশ্চিমের উন্নত দেশের সাধারণ নাগরিকরা হল এই দ্বিস্তর গেমের ‘লিডার’, রাজনৈতিক দল বা নেতারা ‘ফলোয়ার’। তবে এগুলো শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি বা দলীয়পত্রের ইস্তাহার নয়, নেতাদের পুরোমাত্রায় খসড়া দিতে হবে কীভাবে তা বাস্তবায়িত করবেন। হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গায় চলবে না– উন্নয়নের জন্য কোন খাতে কী আসবে, তা নির্ভুল অঙ্ক কষে দেখাতে হবে। নচেৎ, লেবারকে নো ভোট; আরও পঁাচ বছর কনজারভেটিভ-ই সই, ঋষিকে বা তঁার দলকে যতই অপছন্দ করি না কেন।
বিলেতের সঙ্গে আমাদের দেশের নির্বাচনের প্রস্তুতিতে আরও একটা পার্থক্য চোখে পড়ে– শুধু লেবারের মতো প্রধান বিরোধী দলকে নয়, একই কাজ করতে হয়, লিবারাল ডেমোক্র্যাট বা গ্রিন পার্টির মতো ছোট ছোট দলকেও। প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, ক্ষমতায় এলে তারা কী-কী করবে, কীভাবেই বা করবে।
এহেন ছোট কোনও দলের পক্ষে সরকার গড়ার স্বপ্ন তাদের কোনও অতীব শুভাকাঙ্ক্ষীও দেখবে না; তবুও যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে, কীভাবে সেই দল সরকার চালাত, তার সব হিসাব আগাম জানাতেই হয়। উদাহরণ হিসেবে, বিলেতের জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো কোন দল কীভাবে সমাধান করবে, তার ছক কষে, জনগণকে জানাতে হয়। শুধু তা-ই নয়, এ-জাতীয় কোনও আগাম পরিকল্পনা হাতে এলেই অন্য দল খুঁটিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করে ভুলত্রুটি তুলে ধরবে।
আমাদের দেশের নির্বাচন প্রস্তুতি সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারতে আগে প্রচার পায় ইডি, সিএএ; তারপরে আসে ভোট– সেই মডেলে, নেতা আক্ষরিক অর্থেই ‘লিডার’, আর সাধারণ ভোটাররা হল ‘ফলোয়ার’। আমাদের দেশে মোদির বিজ্ঞাপন বা ইস্তাহারকে চ্যালেঞ্জ করে অঙ্ক কষে দেখানোর সৎ সাহস কোনও ছোট দলেরই নেই। তার বদলে, আঞ্চলিক দলের তারকা প্রার্থীরা কেউ বলেন টিভি শো-র কথা, কেউ বা শোনান ক্রিকেটে বিশ্বজয়ের গাথা।
অথচ, বিলেতের নাগরিকদের মতোই সাধারণ ভোটার হিসাবে ভোট দেওয়ার আগে তো আমাদের মনেও একই প্রশ্ন জাগে– কীভাবে আমাদের জীবনযাপনের মান উন্নত হতে পারে; বিলেতের ভোটারদের সঙ্গে আমরা এক্ষেত্রে একাত্মই বোধ করি। তাহলে প্রশ্ন, আমাদের নেতারা বিলেতের লেবার বা গ্রিন দলের নেতার মতো কাজগুলো নির্বাচনের আগে কেন করেন না?
কারণ, বিলেতের নাগরিকদের মতো নির্বাচনের আগে আমরা সেই প্রশ্নগুলোর উপর জোরই দিই না। আমরা ভাবি জিডিপির গরু একদিন গাছে উঠে জগৎসভায় তৃতীয় স্থান নেবে। তা যদি নেয়ও, তাতে কি আমাদের জীবনযাত্রার একটি সমস্যারও সমাধান হবে? তাই দোষটা রাজনৈতিক দল বা নেতাদের নয়। আমাদেরই। আমাদের এই গা-ছাড়া ভাবের সুযোগ নিয়েই নেতাদের ভোট জেতার অ্যাজেন্ডা তৈরি হয়– আমরা তা ‘ফলো’ করি মাত্র।
ভেবে দেখুন, আমরা নিজের জীবনযাত্রার উন্নয়নকল্পে, সমস্যার সমাধানের বিভিন্ন নীতির কথা রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে বাধ্য করতে পারতাম কি? উত্তরে অনেকেই বলবেন, এহেন আশা মূর্খের স্বপ্নে বাস করার শামিল। এসব বিলিতি গল্প আমাদের দেশে চলে না, অহেতুক সময়ের অপচয়।
অপচয় হত না, যদি নির্বাচনের আগে এই সুযোগটা নিদেনপক্ষে বামফ্রন্টের মতো কোনও ‘ছোট’ দলও নিতে পারত। এখন ‘আঞ্চলিক’ দলগুলোর কাছে অন্যরকম রাজনীতি করার একটা সুযোগ ছিল। এমনিতেই যাদের ভঁাড়ার শূন্যই থাকবে, তারা-ই এখন পথপ্রদর্শক হতে পারে। সন্দেশখালি ইস্যুতে কথা না বাড়িয়ে সরাসরি জনজীবনের সমস্যার সমাধানের নীতি প্রণয়ন তারা করতেই পারে। তাতে দল না জিতলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের জয় অবশ্যম্ভাবী।
ঠিক কী করতে হবে? সমস্যা তো অগুনতি। আমাদের গ্রামের স্কুলগুলোয় শিক্ষক নেই। গ্রামের, এমনকী শহরেও, সরকারি হাসপাতালগুলোয় আধুনিক যন্ত্র নেই, পর্যাপ্ত বেড নেই। যুবসমাজের জন্য চাকরি বা জীবিকার্জনের কোনও পথ নেই। অযথা তালিকা দীর্ঘ করা নিষ্প্রয়োজন; বরং এর মধ্যে থেকে কোনও বিশেষ বিষয় বেছে নিয়ে তাতেই ফোকাস করা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক, পরিবহণ ব্যবস্থা। মনে করুন, বামদলের নতুন নেত্রী প্রোজেক্ট হিসাবে বেছে নিলেন নগর-পরিবহণ। কলকাতার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে প্রতিদিন লাখ-লাখ শ্রমজীবী কলকাতায় আসে। ধরা যাক, নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে তিনি স্থির করলেন আমাদের রোজকার পথগ্লানি থেকে মুক্তি দিতে বিলেতের মতো কোনও এক নতুন দিশা দেখাবেন। শুধু লন্ডনের নকলে একটা ছক দিলেই তো হবে না। দলের নেত্রীকে বলতে হবে কীভাবে তিনি এই প্ল্যানকে বাস্তবে রূপায়িত করবেন। অর্থনৈতিক দায়ভার কে নেবে– কীভাবে এই দক্ষযজ্ঞ সামাল দেওয়া হবে।
একইভাবে, কেউ চিন্তা করতে পারেন কীভাবে রাজ্যের সমস্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলের অথবা সব সরকারি হাসপাতালের হাল ফেরানো যাবে। এবার পরিকল্পনা করতে হবে; দেখাতে হবে কী করে তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব। বলা বাহুল্য, কাজটা অতীব শক্ত। তার চেয়ে অনেক সহজ মোদির নিন্দা করা। আরও সহজ নানাবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি ভোটারদের হাতে টাকা গুঁজে দেওয়া। তাতে আখেরে উন্নয়ন বা ‘ওয়েলফেয়ার’ না হলেও, ‘ইনকাম’ তো প্রত্যক্ষভাবেই বাড়ছে। তাতেই আমাদের মতো ভোটাররা খুশি। বিলিতি গল্প আর না-ই বা শুনলাম!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অর্থনীতির অধ্যাপক,
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.