Advertisement
Advertisement

Breaking News

সখী পরকীয়া কারে কয়?

খুঁজে দেখলেন সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়।

Adultery is not a curse anymore!
Published by: Subhamay Mandal
  • Posted:September 28, 2018 2:07 pm
  • Updated:September 28, 2018 2:07 pm  

হাসাহাসি, চোখঠার। যেন মিলে গিয়েছে ছাড়পত্র। যেন বৈধতার হাওয়ায় ঘুরে গিয়েছে হাওয়ামোড়গ। সুপ্রিম রায়ের পর থেকেই পরকীয়া নিয়ে চলছে বেজায় আলোচনা। তবে কিছু প্রশ্ন আগেও থেকে গিয়েছিল, এখনও থাকছে। খুঁজে দেখলেন সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেসবুক জুড়ে তর্ক, ঠাট্টা, বক্তব্য। পাড়ার চায়ের দোকানও সরগরম। উত্তর কলকাতার সমীরণ ঘোষের মুখ গম্ভীর, “সমাজটা একেবারে উচ্ছন্নে গেল”। দক্ষিণ কলকাতার অর্ণব বাবু স্ত্রীকে বলছেন “এমন কথা বাপের জম্মে শুনেছ? পরকীয়া নাকি বৈধ?” মালিনী দেবী, অর্ণব বাবুর কথা শুনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে চা করতে চলে গেলেন। “সমাজটা একেবারে রসাতলে গেল”। আবার স্নিগ্ধা অসীমকে ফোন করে হাঁপ ছেড়ে বলছে… “কাল তাহলে বিকেল পাঁচটা?” ঠিক এইরকম একটা ঘটনা যখন ঘটছে, তখন আসলে কী হচ্ছে বৃহত্তরভাবে? প্রথমেই বুঝে নিতে হবে, এটা কিন্তু কেবল কলকাতায় ঘটছে না, ঘটছে সমগ্র ভারতবর্ষে। কারণ সুপ্রিম কোর্ট একটি চাঞ্চল্যকর (তাই?) রায় দিয়েছেন কাল। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারকের একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গতকাল ঘোষণা করেছে পরকীয়া কোনো অপরাধ নয়। পরকীয়া বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হতে পারে, কিন্তু অপরাধ হতে পারে না কখনোই। অথচ ভারতবর্ষের সংবিধানের ৪৯৭ নং ধারায় ১৫৮ বছর ধরে পরকীয়া একটি অপরাধ ছিল। এই ধারা অনুযায়ী যদি কোনও পুরুষ অন্য কোনও পুরুষের স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া তাহলে এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এবং এই অপরাধে কেবলমাত্র এই বিবাহবহির্ভূত পুরুষটির শাস্তি হবে। সেই মহিলার নয়। এই আইন আরও বলছে, “…a man who has consensual sexual intercourse with the wife of another man without his consent can be punished under this offense in India.” অর্থাৎ প্রথমেই খেয়াল করার বিষয় হল, পরকীয়ার সংজ্ঞা সর্বভাবে নির্ধারিত হচ্ছে যৌনতা দিয়ে। যতক্ষণ না দুটি মানুষ বিবাহবহির্ভূত কোনও সম্পর্কে যৌনভাবে লিপ্ত হচ্ছেন ততক্ষণ তা পরকীয়া নয়, ব্যাভিচার তো নয়ই। ফলে এখানে কুসুমের মনের কোনও প্রশ্নই নেই। হরমোনেরও না। প্রশ্ন কেবল শরীরের। শরীরের প্রজনন অঙ্গের।

Advertisement

[পরকীয়া রায় নারী-বিরোধী, বিস্ফোরক দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন]

এরপরের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল “consensual sex”। অর্থাৎ এই যৌন মিলন কিন্তু ধর্ষণ নয়, কারণ এখানে সেই মহিলার কন্সেন্ট বা সম্মতি আছে, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সম্মতিতে এই যৌন মিলন। কিন্তু তাও যথেষ্ট হচ্ছে না সেই সম্মতি, কেন? কারণ সম্মতি মেলেনি সেই মহিলার স্বামীর কাছ থেকে। অর্থাৎ কী সহজে আর কী সরলভাবে আমরা মেনে নিচ্ছিলাম এতদিন ধরে যে একটি মেয়ের তার নিজের শরীরের প্রতি কোনো অধিকার নেই। বরং তার শরীরের প্রতি অধিকার আছে তার স্বামীর। তাহলে এর উলটোদিকে দাঁড়িয়েও একবার প্রশ্ন করতে হয়, যে যদি একটি মেয়ের ইচ্ছে না থাকে, তাও কি তার স্বামীর সম্মতিতে তাকে কারওর সঙ্গে যৌনভাবে লিপ্ত হতে বাধ্য করা যেতে পারে? তবে অতদূর না গিয়েও এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না, যে ১৫৮ বছর ধরে আমরা একটি ভিক্টোরিয়ান যুগের আদ্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক আইনকে মেনে গিয়েছি। যাঁরা এতদিন গলা ফাটিয়েছেন এই বলে যে কেবলমাত্র বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের পুরুষটিরই শাস্তি হওয়ায় আসলে পুরুষদের প্রতি একধরণের অবিচার করা হয়েছে, সেকথা মেনে নিয়েও তারা যেন না ভুলে যান যে এই আইন কেবল পুরুষদের প্রতি অবিচার করেনি, বরং আজন্ম মহিলাদের পুরুষের হাতের সম্পত্তি হয়ে থেকে যেতে বাধ্য করেছে। যেখানে একটি মেয়ের শরীরের ওপরও তার নিজের কোনও অধিকার নেই। আর তাই ভারতীয় সংবিধান এতদিন ধরে পরকীয়াকে আসলে পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যুদ্ধ বলে ভেবেছে। যেখানে একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের সম্পত্তিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর সেই সম্পত্তি কে? তার স্ত্রী, একজন নারী। যেন তার কোনও ইচ্ছে নেই, যেন তার কোনো মত নেই, যেন তার কোনও সম্মতি নেই। অথচ আইনের ভাষা বলছে “consensual sex”. অর্থাৎ সেখানে কেবল পুরুষটির নয়, মহিলাটিরও মন এবং হরমোন দুইই সাড়া দিয়েছে, কিন্তু তাও তাকে ভাবা হবে নিষ্ক্রিয়। যেমন রূপকথার সেই রাজারা রাজ্য জয় করতে বেরিয়ে হামেশাই পাশের রাজ্যের রানিকে হরণ করে নিয়ে চলে আসত। যেমন রাবণ নিয়ে এসেছিল সীতাকে। তাই এই যুদ্ধ আসলে রাজায় রাজায়, এই যুদ্ধ আসলে রাম আর রাবণের, এখানে রানিরা নিষ্ক্রিয়, এখানে সীতারা সম্পত্তি। ভারতীয় সংবিধানে এ এক লজ্জার ইতিহাস।

[পরকীয়া আর অপরাধ নয়, যুগান্তকারী রায় সুপ্রিম কোর্টের]

মনে পড়ে যাচ্ছে এমিলি মার্টিনের (নারীবাদী নৃতত্ত্ববিদ) একটি লেখার কথা। “The Egg and the Sperm : How Science has constructed a Romance based on stereotypical male-female role” , যেখানে এমিলি বলছেন, কীভাবে বিজ্ঞানও সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়ে বৈজ্ঞানিক সত্যকেও এক লিঙ্গ বৈষম্যের ভাষার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। তিনি বলছেন কীভাবে বহু গবেষক বহুদিন অবধি একটি শুক্রানু ও ডিম্বানুর বর্ণনা দিতে গিয়ে শুক্রাণুকে সক্রিয় ও ডিম্বানুকে নিষ্ক্রিয় করে দেখিয়েছেন। যদিও পরবর্তী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে জানা যায় যে তা একেবারেই সত্য নয়। ডিম্বানু ও শুক্রানুর যৌথ অংশগ্রহণে গর্ভনিষেক হয়। অর্থাৎ বৃহত্তর এক লিঙ্গ বৈষম্যের রাজনীতির শিকার কেবল মানুষের দৈনন্দিনের ভাষা নয় বরং বিজ্ঞানেরও ভাষা। কারণ ভুলে গেলে চলবে না বিজ্ঞানও আসলে লিখিত হয় সেই একই ভাষায় যে ভাষায় তৈরি হয় সংবিধান। আর সেই ভাষা আসলে আজন্মের লিঙ্গ বৈষম্যে ভরা এক সামাজিক ভাষা। যার বদলের প্রয়োজন আছে।

আসলে এই আইন নিয়ে যাঁরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তাঁরা মূলত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ‘বিবাহ’ নামক এক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে। যে প্রতিষ্ঠান অনেকখানি দাঁড়িয়ে আছে একজন নারীর চরিত্রের ওপর। তার শরীরের উপর তার স্বামীর অধিকারের ভিত্তিতে, যে প্রতিষ্ঠান আসলে এক চুক্তি, যে চুক্তির প্রয়োজন পড়ে আক্ষরিক অর্থে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারায়, যে চুক্তির প্রয়োজন পড়ে সন্তানের পিতৃ ও মাতৃপরিচয়ের কারণে, এবং যে চুক্তিতে আমরা পাকাপাকিভাবে এক পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোয় লিখিতভাবে প্রবেশ করি। তাহলে কি প্রয়োজন নেই বিবাহের? সেকথা এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক। তবু মানুষ আজও সেই চুক্তি পেরিয়ে কেবল ভালবাসার কারণেও বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ হন, সেক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব চুক্তির নিরিখে হয়ত পরকীয়া সেই ভালবাসার অমর্যাদা করতে পারে , প্রশ্ন উঠতে পারে দায়িত্বের। আর সেক্ষেত্রে দাবীও করা যেতে পারে বিবাহবিচ্ছেদের। কিন্তু আমার বক্তব্য, সেই পরকীয়াকে যদি আমরা কেবলমাত্র বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে ‘যৌনভাবে’ লিপ্ত হওয়াকে বুঝি তাহলে আসলে ফাঁক রয়ে যাবে বড় এক জায়গায়। বাদ পড়ে যাবে ‘মন’, জিতে যাবে পিতৃতন্ত্র। কারণ মজার বিষয় হল, পিতৃতন্ত্র কেবল মেয়েদেরই নয়, ছেলেদের মন নিয়েও কথা বলে না কক্ষণও।

[‘পরকীয়াকে শাস্তির বাইরে এনে ভালবাসাকেই মর্যাদা দেওয়া হল’]

আসলে ওই যে অর্ণব বাবু বলছিলেন “এমন কথা বাপের জন্মে শুনেছ?” মায়ের জন্ম তো ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয় যা দিয়ে এক সময়কালকে নির্ধারণ করা যাবে। মালিনীদেবী তাই উত্তর দেন না, কারণ এইসব সামাজিক বিষয় তো ঠিক করবেন পুরুষরাই। আর ওই যে বিকেল পাঁচটায় দেখা করবে স্নিগ্ধা আর অসীম, আমি কেবল চাইব তারা যেন বাড়ি গিয়ে তাদের চুক্তিবদ্ধ সঙ্গীদের জানিয়ে দেয় তাদের এই সম্পর্কের কথা। তার কারণ আর কিছুই নয় কারণ তারা একদিন ‘বিবাহ’ নামক এই চুক্তিকে মেনে নিয়েছিল, আর তাই সেই চুক্তির বাইরে গেলে সেই চুক্তি থেকে মুক্ত হওয়াটাই কাম্য। যদিও, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে সেই চারজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বোঝাপড়া ও সিদ্ধান্তের উপর। যে বোঝাপড়া ও সিদ্ধান্তে চারজনেরই সমানাধিকার থাকবে। এটুকুই।
“You only need to hide if you’re doing something you shouldn’t.”
― Paulo Coelho, ‘Adultery’

 

(লেখিকা বিশিষ্ট কবি, সম্প্রতি পেয়েছেন অকাদেমি যুব পুরস্কার)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement