Advertisement
Advertisement

Breaking News

আজব কিসসা কুর্সি কা

রাজনৈতিক মতাদর্শও দিনের শেষে গদির লোভের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়৷

A strange tale of throne in Uttar Pradesh
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:October 30, 2016 4:34 pm
  • Updated:October 30, 2016 4:55 pm  

উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম-অখিলেশের দ্বৈরথে অন্তর্কলহ দেখা দিয়েছে যাদবকুলে৷ পরিবারের মধ্যেই যুযুধান দুই শিবির৷ তবে এই গৃহযুদ্ধে ইন্ধন যোগাচ্ছে কে বা কারা? যদুবংশের মুষলপর্বে লাভ কার? সেই নেপথ্য কারিগরের খোঁজে শুভময় মণ্ডল 

রাজনীতিতে একটা প্রচলিত কথা রয়েছে৷ হামেশাই লোকের মুখে মুখে ফেরে৷ রাজনীতিতে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়৷ তা সে রাজনৈতিক শত্রুতাই হোক বা বন্ধুত্ব৷ আজ যে সবচেয়ে কাছের লোক, সেই কাল সবচেয়ে বড় শত্রু৷ শত্রু-মিত্রর সংজ্ঞা এখানে রোজ পাল্টায়৷ রাজনৈতিক মতাদর্শও দিনের শেষে গদির লোভের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়৷

Advertisement

স্বাধীনতাত্তর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রে উত্তরপ্রদেশের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি লোকসভা কেন্দ্র, বিধানসভা কেন্দ্র, দেশের প্রধানমন্ত্রীর গদিতেও সবচেয়ে বেশি বসেছেন উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধি৷ সবদিক থেকেই পুঞ্জীভূত রাজনৈতিক শক্তির ভূমি হল উত্তরপ্রদেশ৷ আর সেই রাজ্যেই রাজনীতির সংজ্ঞা পাল্টায় প্রতি মুহূর্তে৷ যেমন পালাবদল তেমনই শত্রু-মিত্রর ভূমিকা৷ গোবলয়ের বৃহত্তম রাজ্যে সবধরনের রাজনীতি হয়৷ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বৈচিত্রের রাজনীতি চলে এখানে৷ সেই উত্তরপ্রদেশে বাবরি মসজিদ কাণ্ডের জেরে গোটা দেশে আগুন জ্বলেছিল৷ আবার গো-মাংস রাখার অভিযোগে গণপিটুনিতে নিহত ইকলাখ আহমেদের মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি দেখেছে গোটা দেশের মানুষ৷ অসহিষ্ণুতার বীজও বপন করেছে এই রাজ্যই৷

কিন্তু আজ সেই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ পুরাণের যদু বংশের মুষলপর্বের মতোই শাসকদল সমাজবাদী পার্টির অন্দরেও শুরু হয়েছে মুষলপর্ব৷ এবং সেই গৃহযুদ্ধেই দলের সুপ্রিমো মুলায়মের যাদব বংশ আজ ভাঙনের মুখে৷ মহাভারতের কৌরব-পাণ্ডব শিবিরের মতোই পরিবারের মধ্যেই ভাগ হয়ে গিয়েছে দুই শিবির৷ বেদব্যাসের মহাভারতের মতোই এই পরিবারে রয়েছে অর্জুন, শকুনি, ধৃতরাষ্ট্র, কৃষ্ণরা৷ পারিবারিক দ্বন্দ্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধর মতোই সব মশলাই মজুত রয়েছে৷ মহাভারতে যেমন ছিল হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসার লড়াই, এখানেও তেমন লখনউয়ের মসনদে বসার লড়াই৷ কেউই কাউকে বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ৷

যাদববংশের এই গৃহযুদ্ধে দুই যুযুধান শিবির হল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব এবং তাঁর বাবা তথা দলের প্রধান সাংসদ মুলায়ম সিং যাদবের৷ ২০১২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মায়াবতীর দলকে হারিয়ে যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন মুলায়ম তখন কিন্তু নিজের ছেলের প্রতিই আস্থা রেখে নিজে মুখ্যমন্ত্রী না হয়ে অখিলেশের রাজ্যাভিষেক করেছিলেন৷ যাদবকুলে তখন খুশির হাওয়া৷ তবে সেই খুশির আবহ চার বছরের মধ্যে উবে গেল কীভাবে? অখিলেশ বরাবরই সংস্কারপন্থী৷ রাজ্যপাট চালাতে গিয়ে স্বজনপোষণের ধার না ধেরে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন৷ তাঁর আমলে যে উত্তরপ্রদেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে তা তাঁর চিরশত্রুও স্বীকার করবেন৷ আর রাজ্য চালাতে গিয়ে দলকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজ্যবাসীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই বাবার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন তিনি৷ আগে বলা হত, রাজ্য চলত যাদবদের ঘর থেকে৷ কিন্তু অখিলেশ সেই পথে হাঁটার পরিপন্থী ছিলেন৷ আর তাতেই বাবার রোষে পড়লেন৷ আরও বেশি করে পড়লেন কাকা শিবপাল যাদবের কুনজরে৷ ভাইপোর একরোখা সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলেন না তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য শিবপাল৷ ক্রমাগত মুলায়মের কাছে ভাইপোর নালিশ করে গিয়েছেন৷

কলহের ইতিবৃত্ত শুরু হয় চলতি বছর দেশের স্বাধীনতা দিবসের দিন৷ কুখ্যাত গ্যাংস্টার মুখতার আনসারির ‘কোয়ামি একতা দল’ শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা জানায়৷ কিন্তু শেষমুহূর্তে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন অখিলেশ, ব্যস, চটে লাল শিবপাল মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার হুমকি দেন৷ সেপ্টেম্বরে শিবপাল ঘনিষ্ঠ রাজ্যের মুখ্য সচিব দীপক সিংঘলকে নিয়োগের দু’মাসের মধ্যে সরিয়ে দেন অখিলেশ৷ তখনই প্রথম মুলায়মের দ্বারস্থ হন শিবপাল৷ শিবপালের মন্ত্রণায় উত্তেজিত হয়ে মুলায়ম ওইদিনই তড়িঘড়ি দলের সভাপতি পদ থেকে অখিলেশকে সরিয়ে শিবপালকে নতুন সভাপতি করার কথা ঘোষণা করেন৷ পাল্টা জবাবে পূর্ত দফতর, সেচ, সমবায়-সহ একাধিক দফতরের মন্ত্রী পদ থেকে শিবপালকে বরখাস্ত করেন অখিলেশ৷ নয়া মুখ্য সচিবও নিয়োগ করেন তিনি৷ কয়েকদিনের মধ্যেই দলের নেতা নরেশ আগরওয়াল ঘোষণা করেন, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে অখিলেশই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন৷ দুর্নীতির অভিযোগে শিবপাল ঘনিষ্ঠ দুই মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন অখিলেশ৷ অশান্তিতে ঘৃতাহুতি হতেই ক্যাবিনেট এবং দলের সভাপতিত্ব থেকে ইস্তফা দেন শিবপাল৷ পোড়া ঘায়ে মলম লাগাতে অখিলেশ ফের ঘোষণা করেন, কাকাই থাকবেন দলের সভাপতি৷ শিবপাল ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীকেও ক্যাবিনেটে ফিরিয়ে আনেন অখিলেশ৷ মাঝে দুই শিবিরের বেশ কিছু দলীয় নেতা বহিষ্কার হওয়ার পর মোক্ষম চাল খেলেন মুলায়ম৷ বহু যুদ্ধের সহযোদ্ধা অমর সিংকে দলের সাধারণ সম্পাদক করে দেন৷ অন্যদিকে, অখিলেশকে না জানিয়েই প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেন শিবপাল৷ তারপর একবার ছেলেকেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেন মুলায়ম৷ আবার মত পাল্টে তিনি জানান, দল ক্ষমতায় এলে বিধায়করাই মুখ্যমন্ত্রী চয়ন করবেন৷ এবারই বাবা-ছেলের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব বেধে যায়৷ মুলায়মের ডাকে দলীয় বৈঠক এড়িয়ে যান অখিলেশ৷ এর মধ্যেই অভিযোগ ওঠে, মুলায়মের দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা গুপ্তার ইন্ধনেই পারিবারিক কলহ শুরু হয়েছে৷ মুলায়মের প্রথম স্ত্রীর সন্তান অখিলেশের শিবিরে তখন স্ত্রী ডিম্পল যাদব, মুলায়মের তুতোভাই রাম গোপাল যাদব এবং রাম গোপালের ছেলে অক্ষয় যাদব৷ অন্যদিকে, মুলায়মের স্ত্রী সাধনার শিবিরে তাঁর ছেলে প্রতীক যাদব, পূত্রবধূ অপর্ণা যাদব, দেওর শিবপাল এবং শিবপালের স্ত্রী সরলা যাদব৷

ভাঙনের এহেন পরিস্থিতিতে দলীয় নীতিনির্ধারণ বৈঠকে প্রকাশ্যে কাকা-ভাইপোর হাতাহাতি, ছেলেকে মুলায়মের ধমক, আবার কাকা-ভাইপোর গলায় জড়াজড়ি আর সবশেষে ভাইপোর হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে শিবপালের ঘোষণা, মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যাবাদী আর সভাত্যাগ অখিলেশের৷ লখনউয়ে কানাঘুষো, এ তো মায়াবতী-বিজেপিকে অক্সিজেন পাইয়ে দেওয়ার শামিল৷ শাসকদলের অন্তর্কলহের সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবে বিরোধীরা৷ কিন্তু অখিলেশ জয়ের বিষয়ে আশাবাদী এবং একলা চলোতে অটল৷ আর যাই হোক, এত কিছুর পর বাবা বা কাকা কারও সঙ্গেই যেতে রাজি নন তিনি৷ যদি আগামী নির্বাচনে সপা জিতে যায় তাহলে শম-দম-দণ্ড-ভেদ, সব পন্থাই প্রয়োগ করে লখনউয়ের তখতে তিনি বসবেনই৷ অন্যদিকে, গদিতে বসার লোভে ভাইপোকে এতটুকুও রেয়াত করতে চান না শিবপাল৷ দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনার ইন্ধন এবং ভাই শিবপালের সালিশিতে ছেলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মুলায়ম৷ দল ক্ষমতায় এলে আর যাই হোক, অখিলেশকে মুখ্যমন্ত্রী করবেন না তিনি৷ সেহেতু দলের মধ্যে থেকেই সমর্থন আদায় করা ছাড়া আর কোনও গতি নেই অখিলেশের৷ আদতে সাধনা চান, শিবপালের মাধ্যমে ছেলে প্রতীককে গদিতে বসানো৷ সুতরাং, অখিলেশ, শিবপাল এবং সাধনা, প্রত্যেকেরই নজর গদিতে৷ তবে এখানে একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন অমর সিং৷ মুলায়মের তাঁর উপর অগাধ আস্থা৷ বহু যুদ্ধের সহযোদ্ধা ভোট বৈতরণি পার করতে ওস্তাদ৷ তাই কলকাঠি নাড়ার পিছনে অমরই৷ আজ যাদব পরিবারে অন্তর্কলহের জন্য কিন্তু অমরই দায়ী, শকুনির মতো পরিবারে আগুন লাগানোর লোক তিনিই৷ একদিন এই দলের শীর্ষ নেতৃত্বই বহিষ্কার করেছিল তাঁকে৷ আজ তার প্রতিশোধ নেওয়ার দিন৷ যাদব বংশকে ধ্বংস করার প্রতিশোধ৷ তাই ফের মুলায়মের স্নেহভাজন হয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বের নেপথ্য কারিগর আর কেউ নন, তিনিই৷

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement