লখনউয়ের বিধানভবনের সামনে ‘লাইভ’ করতেই পুলিশি হস্তক্ষেপের সূত্রপাত। কেন বাংলায় কথা বলা হচ্ছে? সরকার-বিরোধী কথা নয় তো? কর্তব্যরত অফিসার কার্যত হুমকি দিলেন– চলে যান, নয়তো লম্বা ফাঁসবেন! লিখলেন স্যমন্তক ঘোষ।
”আপ জানতে হ্যায় ম্যায় কেয়া কর সকতা হুঁ? আপ জেল জায়োগে, অ্যায়সা মুকদ্দমা মে ফাঁসোগে না, সালভর ইয়াদ রাখোগে।”
লখনউ (Lucknow) বিধানভবন দেখতে বরাবরই ভালো লাগে। বিশেষ করে বিকেলের সোনা রোদে। পাথরের ভবনের গায়ে ঠিকরে পড়া আলো আশ্চর্য রং তৈরি করে। সামনের চওড়া রাস্তার উল্টো দিকে ব্যারিকেড লাগানো। আর, তার ঠিক পাশেই বিজেপির প্রদেশ কার্যালয়। সামনের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলে নেতাদের বসার জায়গা। তারপর আইটি সেলের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া অফিস আর সবশেষে মিডিয়া সেল। মিডিয়া সেলের উলটোদিকে গাছের গোড়ায় বিরাট মন্দির। মস্ত ঘণ্টা ঝুলছে সেখানে।
২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন ‘কভার’ করতে এসে এই অঞ্চলে বহু সময় কেটেছিল। মনে পড়ে, বিধানভবনের উলটোদিকে রাস্তার উপর ব্যারিকেড করা জায়গাটায় সারি-সারি ক্যামেরা লাগিয়ে রিপোর্টাররা। কেউ ‘লাইভ’ দিচ্ছে, কেউ-বা পিস টু ক্যামেরায় ব্যস্ত। মনে আছে, দিল্লি থেকে এসেছি শুনে স্থানীয় এক টেলিভিশন রিপোর্টার খানিক শ্লাঘার সঙ্গেই পেশাদার সহকর্মীকে বলেছিলেন, ”আপনাদের পার্লামেন্টের সামনে এমন জায়গা আছে? এটা আমাদের ডেডিকেটেড জোন বলতে পারেন।”
’২২-এর সেই ব্যস্ত দিনের সঙ্গে আম্বেদকর জয়ন্তীর এই রবিবাসরীয় বিকেলের জমিন-আসমান ফারাক। বিজেপি অফিসে সাকুল্যে পঁাচ-ছ’জন লোক গা এলিয়ে আড্ডায়। ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে কোথাও একটা মণ্ডল সভা চলছে, তার লাঞ্চ প্যাকেট এসে পৌঁছেছে এখানেও। যত্রতত্র ছড়ানো মিষ্টি। দু’জন কম্পিউটারের সামনে বসে ইস্তেহারের গুরুত্বপূর্ণ ‘বিন্দু’ বা ‘পয়েন্ট’ নোট করছেন।
আচমকা সাংবাদিক দেখে তঁারা যুগপৎ বিস্মিত এবং বিরক্ত। গেটের হোর্ডিংয়ে মোদি-আদিত্যনাথ ক্রমাগত হেসেই চলেছেন। ব্যানারে নরেন্দ্র দামোদর দাসের গ্যারান্টি। শহর তো বটেই, বিজেপি অফিসেও রাজনাথ সিংয়ের (Rajnath Singh) কোনও চিহ্ন নেই। হতে পারে– ভোট দেরিতে বলে তঁার হোর্ডিংয়ের ফটোশুট এখনও হয়নি। আপাতত দেখে বোঝার উপায় নেই, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই কেন্দ্রের প্রার্থী। প্রায় একই চেহারা বিধানভবনের। গেটে তালা। দু’-একজন পুলিশ ঢালের আড়ালে ঝিমোচ্ছেন। রাস্তায় ধোঁয়া ধোঁয়া পিচ। তাপমাত্রা ৪০।
বিধানভবনের উলটোদিকে যেখানে ব্যারিকেড করা, সেখানে আরেকজন পুলিশ পুলকিত মুখে টানা ভিডিও কলে। আরেকজন চেয়ারে টান-টান হয়ে কপালভাতিতে মগ্ন। কংগ্রেস অফিসের অবস্থা আরও শোচনীয়। গেটে তালা। সমাজবাদী পার্টি অফিসের বাইরে অখিলেশের কনভয়। জ্যামার। কমান্ডো। গাদাখানেক লোক লাল টুপি পরে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত। তারা অপেক্ষায় নিজ-নিজ এলাকার বাহুবলী নেতাদের।
এদিকে, একের-পর-এক এসইউভি থেকে নামছেন নামজাদা নেতারা। তঁারা প্রায় প্রত্যেকেই এসেছেন শেষপ্রহরে ‘বিসমিল্লা’ বলে যদি প্রার্থী-তালিকায় তুলে নেওয়া যায় নাম। শাগরেদদের হাতে দিস্তে কাগজের মতো যাবতীয় ফোন ধরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকছেন। এখানেও মিডিয়ার ভিড় নেই। সকলেই জানেন, যা ‘খবর’ হবে আগামী কাল। সাংবাদিক একবার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই জানিয়ে দেওয়া হল– আজ প্রবেশ নিষেধ। এমন নিষ্কর্মা দিন পেশাদার সাংবাদিকের কাছে শুদ্ধ শাকাহারী চাইনিজের চেয়েও খারাপ। অগত্যা সহকর্মী গৌতম হোড় এবং রাউফ ফিদার সঙ্গে রীতিমতো বৈঠক করে সাব্যস্ত হল, আওয়াধি বিরিয়ানি সঁাটানোর আগে স্যালারি জাস্টিফাই করার জন্যই একটা ‘লাইভ’ করা উচিত।
আর ভোটের ‘লাইভ’ মানে চালচিত্রে বিধানভবন, বলাই বাহুল্য। হাতে চ্যানেলের লোগো লাগানো বুম নিয়ে বিধানভবনের উল্টোদিকের ব্যারিকেডে ঢুকে পড়া গেল। ভিডিও কল-রত পুলিশ হাতের বুম দেখে লাইভে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। যেহেতু জায়গাটিতে ব্যারিকেড লাগানো এবং পুলিশ মোতায়েন করা– তাই নিয়মমাফিক অনুমতি নেওয়া।‘লাইভ’ শুরু হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই উৎপাতের সূত্রপাত। ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছলেন কঁাধে দুই তারকাখচিত একজন পুলিশ অফিসার। বোঝা গেল, সিসিটিভি-তে সাংবাদিকদের দেখে কন্ট্রোল রুম থেকে চলে এসেছেন তিনি। সঙ্গে আরেক অফিসার ব্যারিকেডের ভিতরে ঢুকে সাংবাদিকের লাইভ নিজের ফোনে রেকর্ড করতে শুরু করলেন। ‘লাইভ’ চলাকালীনই প্রথম পুলিশ অফিসার রীতিমতো এনকাউন্টারের ভঙ্গিতে চিৎকার করে লাইভ বন্ধ করার নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। তঁাকে বিনীতভাবে বলা গেল, অনুমতি নিয়েই ‘লাইভ’ শুরু করা হয়েছে। এতে দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে যে-দু’টি কথা বললেন ওই অফিসার, আগে কোনও পুলিশ অথবা সরকারি আধিকারিকের মুখে ‘অফ দ্য রেকর্ড’-ও এমন কথা শুনিনি।
অফিসারের প্রশ্ন, কেন আমরা লাইভে বাংলায় কথা বলছি? ফের বিনীত প্রশ্ন করা গেল, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার বাইরে দঁাড়িয়ে বাংলায় কথা বলা কি নিষেধ? জবাবে পুলিশ অফিসারের পালটা প্রশ্ন, সরকারবিরোধী কথা বলছেন না তো? এখানে দঁাড়িয়ে সরকারবিরোধী কথা বলা যাবে না। আপনারা কী বলছেন বুঝতে পারছি না। সুতরাং, এখানে ‘লাইভ’ করা যাবে না! সাংঘাতিক এই যুক্তি শুনে মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল। রাখা গেলও না। পুলিশ অফিসারকে এবার একটু উদ্ধত ভঙ্গিতেই বলতে হল, ভারতে দঁাড়িয়ে একজন সাংবাদিককে এই প্রশ্ন সম্ভবত করা যায় না! আর, কোন ভাষায় সাংবাদিক কথা বলবেন, তা-ও পুলিশ নির্ধারণ করে দিতে পারে না। এটা তার এক্তিয়ারের বাইরে। এবারই শুনতে হল সেই অমোঘ হুমকি– ‘আপ জানতে হ্যায় ম্যায় কেয়া কর সকতা হুঁ? আপ জেল জায়োগে, অ্যায়সা মুকদ্দমা মে ফঁসোগে না, সালভর ইয়াদ রখোগে।’ অফিসার বলেই যাচ্ছেন– এমন আইনে আপনাকে ‘বুক’ করতে পারি, সহজে জামিনও মিলবে না।
একবার নয়, বার বার কথাগুলো বলছেন অফিসার। তবে তঁার পাশে দঁাড়িয়ে থাকা অন্য অফিসার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রণং দেহী ওই অফিসারকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সাংবাদিককে বোঝানোর চেষ্টা করছেন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে। বলছেন, ওই জায়গা থেকে সাধারণ দিনে ‘লাইভ’ করার জন্য হেড কোয়ার্টার থেকে অনুমতি নিতে হয়। একই সঙ্গে তিনি এ-ও স্বীকার করছেন, বাইরে থেকে আসা সাংবাদিকের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। ফলে, কথা না-বাড়িয়ে সমস্যা মিটিয়ে ফেলাই শ্রেয়।
লখনউ শহরের যেখানে দঁাড়িয়ে এই বচসা চলছে, সেখান থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে এ. পি. সেন রোড। অতুলপ্রসাদ সেন। ইংল্যান্ড থেকে লখনউয়ের বার অ্যাসোয়িশনে তিনি এসেছিলেন আওয়াধের এক বন্ধুর অনুরোধে। এই লখনউতে বসেই সম্ভবত তিনি লিখেছিলেন– ‘কে আবার বাজায় বঁাশি, এ ভাঙা কুঞ্জবনে।’ কলোনিয়াল স্ট্রাকচারে তৈরি তঁার সেই বাংলো এখন আর নেই। কেবল রাস্তাটাই থেকে গিয়েছে। মনে পড়ছিল, একসময় প্রবাসী বাঙালির অন্যতম পীঠস্থান ছিল লখনউ। সেখানে কিনা এখন বাংলায় কথা বলতে গেলে পুলিশের চোখরাঙানির সম্মুখীন হতে হয়।
না, এটা কেবল একজন পুলিশ অফিসারের ব্যতিক্রমী আচরণ নয়। মনে পড়ছিল, বর্ধমানের সেই ছেলেটির কথা, উত্তরপ্রদেশে কাজ করতে গিয়ে ‘বাংলাদেশি’ বলে যাকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল। বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। দক্ষিণ ভারতের এক শহরে এখনও জেলবন্দি গ্রাম বাংলার আরেক বাঙালি। তাকেও ‘বাংলাদেশি’ বলে বেশ কিছু দিন হল গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মুর্শিদাবাদে তার বাড়ি গিয়েছিল সাংবাদিক। রিপোর্টারের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তার বাবা। বলেছিলেন, সাতজন্মে তঁাদের পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও সম্পর্ক নেই।
মনে পড়ছে, মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি নেতা, বেশ কয়েক বছর যিনি কিনা পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ছিলেন প্রদেশ বিজেপিতে, সটান বলে দিয়েছিলেন, যারা মুড়ি খায়, তারা ‘বাংলাদেশি’। মনে পড়ছে, তখন মোগলসরাই, অধুনা ‘দীনদয়াল উপাধ্যায়’ স্টেশন থেকে, হাওড়াগামী ট্রেনে চড়ার পর উত্তরপ্রদেশের এক সহযাত্রী বাঙালির খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা রাক্ষসের জাত! মাছ-মাংস কিচ্ছু ছাড়েন না। কিন্তু এখানে খাবেন না। আমরা শুদ্ধ শাকাহারী। ওসব খাবার দেখলে অস্বস্তি হয়।’ মনে পড়ছে, নবরাত্রির সময় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য। মনে পড়ছে, ওই সময় কীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় উত্তরপ্রদেশের মাংসর দোকান, ইদানীং দিল্লিতেও। মনে পড়ছে, অযোধ্যা থেকে উত্তরপ্রদেশের রাস্তায় একের-পর-এক আম্বেদকরপন্থী মিছিল দেখে দলিত ভোট নিয়ে ব্রাহ্মণ গাড়িচালকের টিপ্পনী। কেন গ্রামে তফশিলি জাতির মানুষদের তারা নিজেদের বাড়িতে ডাকে না, কেন দলিত সমাজের কেউ ব্রাহ্মণকে বাড়িতে ডাকলে তারা জলও স্পর্শ করে না, কেন এখনও এক গ্রামে উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ আলাদা এলাকায় থাকে। কেন স্কুল থেকে চাকরি মায় সংসদ—সংরক্ষণ তুলে দেওয়া উচিত।
মনে পড়ছে, রামমন্দির ঘিরে পরিক্রমা পথ তৈরির জন্য শয়ে-শয়ে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে। তেমনই তিন কামরার ঘর এক কামরায় এসে ঠেকা এক নারী সাংবাদিককে বলেছেন, “‘ছোট জাত’ বলেই হয়তো আমাদের বাড়ি এত সহজে ভাঙা যায়! কই ব্রাহ্মণের বাড়িতে তো হাত পড়ছে না!” মনে পড়ছে, ‘বুলডোজার বাবা’ মুসলিমদের কীভাবে জব্দ করছেন, তা নিয়ে উত্তরপ্রদেশের এক প্রবীণ সাংবাদিকের বিনম্র লেকচার। মনে পড়ছে হাথরাস, নু, দাদরি। মনে পড়ছে, গোরক্ষা বাহিনীর সেই নেতার কথা, রাতে দল বেঁধে যারা হাই রোডে পুলিশের নাকের ডগায় ট্রাক পরীক্ষা করে। কোনও ট্রাকে পশু থাকলে চালককে নামিয়ে বেধড়ক মারের সেই দৃশ্য। মনে পড়ছে, উত্তরপ্রদেশের একাধিক সাংবাদিকের কথা, দেশদ্রোহিতা এবং এমনই আরও অনেক গভীরতর অপরাধে যঁারা এখনও জেলবন্দি।
মাথাটা কোনওভাবেই ঠান্ডা হচ্ছে না দেখে ফেসবুকের আশ্রয় নিল সাংবাদিক। শোনা যায়, সমাজমাধ্যমে অকারণ আঙুলসঞ্চালন নাকি মানসিক অবসাদ ভুলে থাকার এক ভয়াবহ রাস্তা। কাজ যে একেবারে হচ্ছিল না, এমন নয়। আচমকা চোখে পড়ল কলকাতার একটি ‘বাংলা’ গ্রুপের পেজ। সগর্বে তারা ঘোষণা করেছে, কেন পশ্চিমবঙ্গে এসে অন্য ভাষায় কথা বলা যাবে না। কলকাতা-সংলগ্ন এক অবাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলকে কার্যত বয়কট করতে বলা হয়েছে ওই লম্বা পোস্টটিতে।
ওই পোস্টের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের এক পুলিশ অফিসারের কণ্ঠের কোনও তফাত আছে কি? লখনউয়ের এক প্রসিদ্ধ রেস্তোরঁা-চেনে কাজ করতে যাওয়া মালদার এক যুবক যখন বলছিলেন– মুসলিম বলে শুধু নয়, বাঙালি বলেও লখনউয়ের যে কোনও এলাকায় তিনি বাড়ি পান না। মনে হচ্ছিল, মেটা-র ওই পোস্টটির বহিঃপ্রকাশ যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি লখনউয়ের ফুটপাতে। পরিচয়ের এই রাজনীতি বরাবরই ছিল উত্তর ভারতে। এখন দেশজুড়ে, এমনকী বাংলাতেও।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.