Advertisement
Advertisement
Sandhya Mukherjee

হতে পারতেন কি লতার আগের লতা?

সীমাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করেই শৃঙ্গারোহণ কিংবদন্তি শিল্পীর।

A memoir of legendary singer Sandhya Mukherjee। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:February 16, 2022 10:27 am
  • Updated:February 16, 2022 11:35 am  

গৌতম ভট্টাচার্য: সহেলিও যে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে ভরতি, সেই খবর লতা মঙ্গেশকরকে (Lata Mangeshkar) জানাননি তাঁর ঘনিষ্ঠরা। পাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (Sandya Mukherjee) অসুস্থতার কথা শুনে অতি রুগ্‌ণ লতার মানসিক চাপ আরও বাড়ে। রাজ সিংহ-উত্তর লতার জীবনে যিনি তাঁর পুত্রসম সহকর্মী ছিলেন, রেকর্ডিং থেকে লতার নিজস্ব স্টুডিও– সব দেখাশোনা করতেন, মঙ্গেশকর পরিবারের কাছে অতীব বিশ্বাসযোগ্য সেই ময়ূরেশ পাইকে মঙ্গলবার রাতে ফোনে ধরায় স্তম্ভিত শোনাল তাঁর গলা: ‘‘সে কী, দিদি চলে যাওয়ার তো দশদিন কাটল না। এর মধ্যে উনিও!’’ ময়ূরেশ কী করে জানবেন বাংলার আর্তির তিনি প্রতিধ্বনি করছেন। লতা যেতে না যেতেই সন্ধ্যা। এ কী ভয়াবহতা!

২০১১ সাল মনে করিয়ে দেয়। সে বছরে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে দুদ্দাড়িয়ে চলে যেতে থাকেন জগজিৎ সিংহ, দেব আনন্দ, ফিদা হুসেন, ভূপেন হাজারিকা, টাইগার পতৌদি, শাম্মি কাপুররা। শিল্পীমহলে এমন ত্রাস আর বিষণ্ণতা ছড়িয়েছিল যে, কলকাতা বসে আমাকে একটি ইন্টারভিউ দেওয়ার ফাঁকে শাহরুখ খানের মতো ‘পজিটিভ মানুষও টেপের সামনে বলেছিলেন, ‘‘ইন্টারভিউটা শেষ করে বারান্দায় পৌঁছে হয়তো দেখব আমি জীবিত নেই! দলাই লামার কথা মনে করিয়ে দেয় যে, তুমি কখনওই জানো না– কোনটা আগে ধেয়ে আসছে? আগামীকাল না তোমার মৃত্যু?’’

Advertisement

[আরও পড়ুন:প্রয়াত বাপি লাহিড়ী, ফের নক্ষত্রপতন সংগীত দুনিয়ায়]

সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিনোদনের বাংলা কি মৃত্যু নিয়ে তেমনই হ্যাংওভারে ডুবে যাওয়ার উপক্রম করছে? নারায়ণ দেবনাথ যেতে না যেতে শাঁওলী মিত্র, সুভাষ ভৌমিক, লতা, এবং এরপর তিনি– বাঙালির প্রিয়তম সন্ধ্যাতারা। ডেস্কটপে উপরে পতৌদির নামটা লিখতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ‘নবাব’ সম্পর্কে বলা হত, প্রকৃতির আপন খেয়ালে জন্মানো বিরল প্রতিভা। যিনি এক চোখ দিয়েও ফাস্ট বোলিং খেলে দিতে পারেন। একটা ক্রিকেটতর্ক শর্মিলা ঠাকুরকে অহরহ শুনতে হয়েছে, দুটো চোখ থাকলে কি টাইগার হতেন ‘শচীনের আগের শচীন’?

স্থানীয় সংগীত অনুরাগীরও জল্পনার সময় হয়েছে যে ঢাকুরিয়ার মাছ-ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালি সন্ধ্যার দুটো কান অক্ষত থাকলে তিনি কি হতেন ‘লতার আগের লতা’? মাত্র ষোলো বছর বয়সে দুরারোগ্য মাম্‌সে দুটো কান পুরো বিকল হয়ে যায়। ডান কানে কিছু শুনতেই পেতেন না। ভাবা যায়, এই মাপের কিংবদন্তি শিল্পীকে কী পরিমাণ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করে শৃঙ্গারোহণ করতে হয়েছে! একটা কান নেই মানে তো তাঁর সংগীত পরিচালকের নির্দেশ শোনা, নিজের গানের ছন্দ বোঝা– টক ব্যাকে সব একটা কানে। দুটো কান মিলিয়ে ব্যালেন্সিংয়ের ছন্দটা অনুভব করতে করতে নিজের গানকে উত্তীর্ণ করার অনায়াস পদ্ধতিই তো বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কী বিশাল সমস্যা গানে ব্যুৎপত্তি না-থাকা সমাজও বুঝবে।

sandhya

[আরও পড়ুন: সুরের মৃত্যু হয় না, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানের ‘ইন্দ্রধনু’ চিরকাল থেকে যাবে বাঙালির সঙ্গে]

বিখ্যাত গায়ক তো কতই প্রসব করেছে বাংলা। মান্না, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, সতীনাথ। ‘স্বর্ণযুগ’-এর শেষ প্রতিনিধি হারিয়ে গেলেন বললে কমিয়ে বলা হয়। বলা উচিত, একমাত্র সংগীতকে ধর্মাচরণের মতো করে দেখে শুদ্ধভাবে জীবন কাটানোর শেষ প্রতিনিধি হারিয়ে গেলেন। ঘনিষ্ঠরা বলত, লতা এবং তিনি একইরকম। সংগীতে বাঁচেন। সংগীতে ঘুমোন। সংগীতে শ্বাস নেন। কিন্তু তারই মাঝে অদ্ভুত রোমান্টিকতা মনের মধ্যে অক্ষত রেখে দিয়েছেন। নইলে হাসপাতালে ভরতি হওয়ার আগে পর্যন্ত এত মিষ্টি আর সুরেলা গলা অক্ষত কী করে?

এমনিতে সমগ্র জীবনের অনেকটাই কাটিয়েছেন সুচিত্রার মতো জনতা থেকে দূরে। ইন্টারভিউ দেওয়ায় তীব্র অরুচি ছিল। এক-আধজন বাদে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতেন না। নিজের মতো করে সুন্দর সিস্টেম তৈরি ছিল তাঁর। কোভিডকে প্রায় দু’বছর সফল মোকাবিলাও করেছিলেন। সামান্য শীত পড়লেই ঘরে রুম হিটার জ্বালতেন। পারতপক্ষে, মানুষজনের সঙ্গে দেখা করতেন। প্রতি বুধবার করে হারমোনিয়াম বের করতেন। যা রাখা থাকত একটা ট্রলির উপর। কথা বললে বোঝাই যেত না, ইনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যুগ যুগ ধরে অমর সাংগীতিক অভিজ্ঞান। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, নিজের প্রচার, ব্র্যান্ডেড জিনিসপত্র, এসব ক্রিয়াকর্ম জীবনে তাঁর আশেপাশে ঘেঁষতে সাহস করেনি। টোয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন শুধু গান। বেসুরো গলার বাথরুম সিংগারকেও তিনি ফোনে গাইতে বাধ্য করেছেন। বলেছেন, গাইতে গাইতে সুর আসবে। ভাব আসবে। সব কি একদিনে হয়?

কেউ কোথাও ভাল গাইছে শুনলে এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে যেতেন যেন তিনি রিয়ালিটি শো-র দর্শক আর ওই মেয়েটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একাধিকবার বলেছেন, ‘‘বাণিজ্য নিয়ে জীবনে ভাবিনি। সাফল্য নিয়েও না। আমি শুধু গান আঁকড়ে রাস্তা চলেছি।’’ পরিচিতরা জানেন এর চেয়ে সত্যি কথা হয় না!

পাকেচক্রে আমার মাধ্যমে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আবার তাঁর আর লতার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। দু’জনে হিন্দিতে ডুয়েট গেয়েছেন জানতাম না। প্রথম বলেন লতা। তিনি জাতীয় যুদ্ধ জিতেছেন। এসব উদারতা দেখাতেই পারেন। সন্ধ্যা– তিনি কি পারতেন না সখী-রাজত্ব নিয়ে অফ দ্য রেকর্ড দুটো হালকা শব্দ ভাসিয়ে দিতে? যেখানে নিজের বোন আশা এত কথা বলেছেন! কিন্তু কোনও দিন করেননি। সেই মননই ছিল না। প্লে ব্যাক সিঙ্গাররা সাধারণভাবে বলে থাকেন যে, পর্দায় গানটা পড়লে লোকে তাঁদের কথা অনেক সময় ভুলে যায়। ‘ক্রেডিট’ চলে যায় নায়ক-নায়িকার উপর। তিনি, সন্ধ্যা, ঠিক উলটো কথা বলতেন, সুচিত্রা এত ভাল লিপ দিত বলে গানগুলো এমন ফুটত!

জীবনে একবারই বোধহয় মিঠে আওয়াজটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ‘পদ্মশ্রী’ দিতে চেয়ে ২৫ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটের ফোনটা আসার পর। ‘খবর’ পেয়ে তার ঠিক পনেরো মিনিট পর তাঁকে ফোন করে যে-গলা শুনি তা এর আগে শুনিনি। এটা চরম অসম্মানিত, উত্তেজিত এবং অপমানিত কোনও মর্যাদাসম্পন্ন বৃদ্ধার। যে-জীবনটা একটা সম্মানিত ঘেরাটোপে এতকাল কাটাতে পেরেছে, এবার তা ভেঙেচুরে কুপ্রস্তাবকারীরা ঢুকে পড়েছে।

দিয়েগো মারাদোনা বলেছিলেন, আজীবন তিনি খোঁজ নিয়ে যাবেন নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে পেনাল্টি দেওয়া সেই রেফারি কোডোসাল কোথায় আছে। কী করছে। অসুস্থ কি না। ক্রুদ্ধ বাঙালিও হয়তো আজীবন খোঁজ নেবে ওই বিকেল সাড়ে চারটের ফোনকারী আমলাটি কে। তাঁর নাম কী।

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement