কুণাল ঘোষ: রামপুরহাটের (Rampurhat Incident) বগটুই গ্রামে যা ঘটেছে, তা দুঃখজনক। প্রতিবাদযোগ্য। সরকার, প্রশাসন তদন্ত করছে। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস এই অবাঞ্ছিত ঘটনা নিয়ে যে রাজনীতি করছে, তা কি গ্রহণযোগ্য? এনিয়ে কোনও কথা বলার নৈতিক অধিকার কি তাঁদের আছে?
১. ঘটনা ও তদন্ত: ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থা। ওসি ক্লোজড, এসডিপিও অপসারিত, সিট গঠিত। বাম জমানায় হত? এখানে প্রথমে খুন তৃণমূলের জনপ্রিয় নেতা। তারপর রাতে অগ্নিকাণ্ড। মারা গেলেন তৃণমূল (TMC) সমর্থকরাই। এর মধ্যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের গন্ধ। তৃণমূলকে বিব্রত করতে, বাংলাকে বদনাম করতে, কেন্দ্রনির্ভর পরজীবীদের ইস্যু তৈরির চেষ্টায় তৃণমূলের নেতাকে খুন করে, তৃণমূলের সমর্থকদেরই পুড়িয়ে মেরে চক্রান্ত চলছে না তো? তদন্ত হোক। মনে রাখুন, অতীতের ঘটনায় শাসকের এলাকাদখল, জমিদখল টার্গেট ছিল। সংগঠিত অপরাধ ছিল। এক্ষেত্রে সে সব ছিল না।
২. তফাত দেখুন: এর আগে যে ধরনের গণহত্যা বাংলায় আগের জমানায় বা অন্য রাজ্যে ঘটেছে, তার সঙ্গে সরাসরি শাসকদল ও সরকারি বাহিনীর যোগ ছিল। রামপুরহাটের ঘটনায় সে সব কিছুই ছিল না। রামপুরহাটে রাজ্য সরকার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে। সিট হয়েছে। বাম জমানা, ভিনরাজ্যের বিজেপি (BJP) সরকারের জমানায় পরের পর ভয়ংকর ঘটনা, সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারের ব্যবস্থা, হয়েছে কখনও? এঁরাই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চাইছেন!!! বিস্ময়ের।
৩. বামজমানার কাণ্ড: বাম নেতারা রামপুরহাটে। ফটো সেশন চলেছে। এঁদের মুখে সন্ত্রাসের নিন্দা? মরিচঝাঁপি, সাঁইবাড়ি, বিজন সেতুতে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের জীবন্ত পুড়িয়ে খুন, ছোট আঙাড়িয়া, সুচপুর, ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই, নানুর, নেতাই, হরিহরপাড়া, নন্দীগ্রামের মতো ঘটনাগুলিতে যাদের হাত রক্তে লাল, সেই সিপিএম এখন সাধু সেজে বাণী দিচ্ছে? যে বামজমানায় সিপিএমের পুলিশ কোচবিহারে ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মীদের গুলি করে মারে বা বাসন্তীতে আর এস পি মন্ত্রীর বাড়িতে বিস্ফোরণে আত্মীয়া মারা যান, সেই নেতারা মানুষকে অতীত ভুলিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কুৎসা করছেন? রামপুরহাট বা এধরনের ঘটনা অবাঞ্ছিত। দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু সিপিএম জ্ঞান দেওয়ার অধিকার হারিয়েছে অনেক আগেই।
৪. বিজেপির কীর্তি: গুজরাত দাঙ্গার পর ৩৫৬ হয়েছিল? প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী তখনকার মুখ্যমন্ত্রী এই নরেন্দ্র মোদিকে বলেছিলেন, রাজধর্ম পালন করুন। তবু ৩৫৬ হয়নি। ক’দিন আগেও সেখানকার এখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় জানিয়েছেন, দু’বছরে রাজ্যে হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮৮। দিল্লির দাঙ্গায় দর্শক ছিল কেন্দ্র। উত্তরপ্রদেশে একের পর এক ঘটনা, হত্যা, লখিমপুরেও কৃষক হত্যা। আগরতলায় সন্ত্রাস, থানা আক্রমণ। এনডিএ-র বিহারে থানায় লকআপে মৃত্যুর প্রতিবাদে হামলায় পুলিশহত্যা। বিজেপি ও তার বন্ধুদের রাজ্যে ভয়ংকর সব ঘটনা। তদন্তে নানা অভিযোগ। আর এখানে রামপুরহাট নিয়ে বিজেপির বড় বড় কথা? মানুষের দরবারে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পিছনের দরজা দিয়ে নাক গলানোর অপচেষ্টা? এরাজ্যে কারা বিজেপি? আদি, তৎকাল, পরিযায়ী গোষ্ঠী। তদন্ত থেকে বাঁচতে তৎকাল বিজেপি সাজা কেউ কেউ নিজের অস্তিত্বরক্ষার জন্য শকুনের রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরছেন মরিয়া হয়ে। এঁদের মুখ থেকে জ্ঞান শুনবে তৃণমূল? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এনিয়ে কথা বললেন, গুজরাত দাঙ্গার পর যাঁকে ‘রাজধর্ম’ শেখাতে হয়েছিল তাঁরই দলের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। তিনি জ্ঞান বিলোবেন আর বাংলা শুনবে?
৫. কংগ্রেসের কথা: ক্ষমতা থেকে কংগ্রেস এতকাল দূরে যে উদাহরণও পুরনোই। দিল্লির শিখদাঙ্গার নিধনযজ্ঞ ভুলে গেলেন? মানুষ বিচার পেয়েছেন তো? বাংলার কথায় আসুন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭, বামেরাই তো বলেন সন্ত্রাসের জমানা। অন্তত দু’টি জেলার তিন দশকের ক্রাইম রেকর্ড দেখলে বোঝা যাবে অভিযোগ কার বা কাদের বিরুদ্ধে। যে বামজমানায় হাজার হাজার বিরোধী কর্মীর খুন ভুলে তাদেরই সঙ্গে হাত মেলানোর পরেও বিধানসভায় কংগ্রেস শূন্য, তারা আজ তৃণমূলের সমালোচনা করবে?
৬. পুলিশ সুপার: বীরভূমের পুলিশ সুপার নগেন্দ্র ত্রিপাঠী। বিধানসভা নির্বাচনের সময় নন্দীগ্রামে এই নগেন্দ্র ত্রিপাঠীর ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিল তৃণমূল। তখন ত্রিপাঠীসাহেবের মধ্যে বাজিরাও সিংহমকে আবিষ্কার করেছিল। জয়ধ্বনি দিয়েছিল। পরে সরকারি সম্মানও পান ত্রিপাঠী। তাঁর একটি সংলাপ বিখ্যাত হয়েছিল- উর্দিতে দাগ লাগতে দেব না। সেদিন বিজেপি ত্রিপাঠীর নামে খুশি ছিল। আজ কেন বীরভূম পুলিশের উপর আস্থা না রেখে ইস্যু তৈরির নাটক চলছে?
৭. বৃহত্তর ষড়যন্ত্র: রামপুরহাটের ঘটনায় কারা তৃণমূলের নেতাকে মারল, আবার তৃণমূল সমর্থকদেরও মারল? কারা কদিন আগে থেকে হঠাৎ ৩৫৬ বা যেনতেন প্রকারে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের কথা বলছিল? কীভাবে রাতারাতি রাজ্য বিজেপি, দিল্লির বিজেপি, রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কথা একসুরে বাঁধা? স্থানীয় রাজনীতির রেষারেষি নয়, বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিত যেন স্পষ্ট।
শেষে আবার বলি, রামপুরহাটের ঘটনা অতি খারাপ ঘটনা। কিন্তু আন্দোলন, মিটিং-মিছিল তখনই দরকার হয়, যদি সরকার বা প্রশাসন ব্যবস্থা না নেয়। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা হচ্ছে। ফলে বিচ্ছিন্ন একটি খারাপ ঘটনা নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। আর দেখার বিষয় এই রাজনীতিটা করছে কারা? বাম, বিজেপি, কংগ্রেস? তাদের কথা বলার নৈতিক অধিকার আছে কি?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.