ব্রিগেডে বক্তব্য রাখছেন মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া।
সরকারি ভাবে না হলেও প্রবীণ, পক্ককেশধারী আলিমুদ্দিনের কর্তারা এই সমাবেশের মুখ হিসাবে এগিয়ে দিয়েছিলেন ‘তরুণ তুর্কি’ মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে। সাদামাঠা, মেঠো স্টাইলে কথা বলা পাশের বাড়ির মেয়ে ভাবমূর্তির অধিকারী কুলটির এই তরুণী ইতিমধ্যে বেশ সাড়াও ফেলেছেন। কলমে অরূপ কর
রবিবাসরীয় দুপুরে তুমুল উদ্দীপনা, আবেগ, উৎসাহের জোয়ারে ‘যৌবনের ডাকে’ ব্রিগেডে সিপিএম যুবদের বড় সমাবেশের সাক্ষী রইল কলকাতা। ছুটির দিনে শীতের দুপুরে মহানগরীর চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, ময়দান, বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম সফরের চেনা ছবি থেকে একটু ভিন্ন চিত্র দেখল কল্লোলিনী কলকাতা। গত কয়েক মাস ধরে গ্রামবাংলায় ডিওয়াইএফআই একাধিক দাবিতে যে ইনসাফ যাত্রা কর্মসূচি চালাচ্ছিল, তারই পরিসমাপ্তি এই সমাবেশ। কোনও কোনও মহল ফুৎকারে এই কর্মসূচিকে উড়িয়ে দিয়ে ভোটের ফলে ‘সিপিএম সেই শূন্যই থাকবে’ বা ‘সিপিএম বিজেপির বাক্সে চলে যাওয়া ভোট আগে ঘরে ফেরাক’ বলে মুখ ফিরিয়ে থাকতেই পারেন, গতকালের ব্যতিক্রমটুকু বাদ দিলে মূল স্রোতের মিডিয়া গোটা যাত্রাকে উপেক্ষা করে কার্যতঃ কোনও কভারেজ না দিতেই পারে, কিন্তু তার তাৎপর্যকে কোনওভাবেই খাটো করা যাবে না। কারণ এই সমাবেশ অনেকগুলি বার্তা দিয়ে গেল, যা ভেবে দেখার মতো।
সিপিএমের নামে নয়, গোটা কর্মসূচিটা হয়েছে দলের যুব সংগঠনের উদ্যোগে। এক দশকের ওপর দল ক্ষমতায় নেই। সেই সংগঠনও অতীত। বহুদিন বাদে শুধুমাত্র যুবদের গ্রামবাংলা থেকে ব্রিগেডে লোক আনার দায়িত্ব দিয়ে ডিওয়াইএফআই সংগঠন কতটা সক্রিয়, সচল, সেটা হয়তো যাচাই করে নিতে চাইছিল পার্টি। গতকালের সমাবেশের ভিড়, উচ্ছ্বাস দেখার পর অস্বীকার করার উপায় নেই, ব্রিগেড ভরানোর জন্য যে সাহস, কলজের জোর লাগে, সেটা দেখিয়েছে সাদা পতাকার ওপর তারাখচিত ধ্বজার বাহকরা।
সরকারিভাবে না হলেও প্রবীণ, পক্ককেশধারী আলিমুদ্দিনের কর্তারা এই সমাবেশের মুখ হিসাবে এগিয়ে দিয়েছিলেন ‘তরুণ তুর্কি’ মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে। সাদামাঠা, মেঠো স্টাইলে কথা বলা পাশের বাড়ির মেয়ে ভাবমূর্তির অধিকারী কুলটির এই তরুণী ইতিমধ্যে বেশ সাড়াও ফেলেছেন।
ব্যক্তি নয়, পার্টিই বড়–মৌখিক ভাবে, পার্টির তাত্ত্বিক দলিলে বরাবর এই কট্টর অবস্থান বজায় রাখা সিপিএমে যা বেনজির বলা যায়। আমজনতা যে পার্টির তাত্ত্বিক কথাবার্তায় ভরসা করার চেয়ে নেতা হিসাবে পছন্দের একটা মুখ খোঁজে, মাটির কথা শুনতে চায়, এই সহজ সত্যটা সিপিএম এতদিন স্বীকারই করত না। পার্টিতে হাজারটা দাপুটে নেতা থাকলেও মানুষ যে প্রয়াত জ্যোতি বসু, সুভাষ চক্রবর্তীদের মতো নেতাদেরই মুখ হিসাবে মনে করতেন, এটা পার্টি মানত না। মীনাক্ষীকে সামনে এগিয়ে দিয়ে, সমাবেশের অন্যতম প্রধান বক্তা হিসাবে মঞ্চে তুলে পার্টি নয়, মুখই আসল, এটা স্বীকার করে নিল সিপিএম।
শুধু মীনাক্ষী কেন, মহম্মদ সেলিমকে বাদ দিলে বাকি চেয়ারগুলিতে কেবলমাত্র যুবদের তুলে দিয়ে সিপিএম আরও দেখাল, আগামী দিনে তরুণ রক্তের ওপরই ভরসা করতে হবে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে। আবার, মঞ্চে ঠাঁই পাওয়া যুব নেতাদের মধ্যে শতরূপ ঘোষ, কৌস্তভ চট্টোপাধ্যায়ের মতো টিভি চ্যানেলের টক শো-এর মুখদের রাখেনি পার্টি। কার্যতঃ এটাই যেন বোঝাতে চাওয়া হল, শুধু দু-একটা সোশাল মিডিয়ায় পরিচিত মুখ নয়, সামগ্রিক ভাবে গোটা যুব নেতৃত্বের ওপরই আস্থা রাখা হচ্ছে। বোকা বাক্সে মুখ দেখিয়ে বড়াই করার চাইতে ময়দানে লড়াই করলেই ঝান্ডার ফিকে রঙে আবারও লালের আভা গাঢ় হবে।
গতকালের সভা শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক আলোচনার কেন্দ্রে থাকা রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ দিয়ে। কিছুদিন আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গানটিকে ‘রাজ্য সঙ্গীত’ এর স্বীকৃতি দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, তবে কি মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকেই স্বীকৃতি দিলেন সিপিএম যুবরা? এ হয়তো নিছকই কাকতালীয়। তার চেয়েও বড় কথা, এককালে রবীন্দ্রনাথকে ‘বুর্জোয়া কবি’ তকমা দিয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ করা কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ নেতাদের এ কী হল যে, সমাবেশের সূচনায় সেই কবিগুরু-র গানকেই আশ্রয় করতে হল! তবে কি এরপর থেকে পার্টির যে কোনও সভা-সমাবেশে রবীন্দ্রগান গাওয়া হবে? সলিল চৌধুরি, হেমাঙ্গ বিশ্বাসদের অমর সৃষ্টি হিসাবে স্বীকৃত গণসঙ্গীত গাওয়াই রেওয়াজ সিপিএম ও তার শাখা সংগঠনের সভা-সমাবেশে। এবার কি তাহলে গণসঙ্গীতের পাশে স্থায়ী মর্যাদা পাচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীতও?
আরও ব্যতিক্রম, চমক ছিল সভা চলাকালে, শেষেও। কমিউনিজমের সমর্থক যুবদের সভায় উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকাও! বাম সভায় স্বগরিমায় তেরঙ্গা উড়ছে পতপত করে, এই দৃশ্য বিস্ময় সৃষ্টি করবেই। তবে কি সিপিএম যুবরা বিজেপি মোকাবিলায় পালটা জাতীয়তাবাদী আবেগও উসকে দিতে চাইছে? তবে কি ‘নেশন স্টেট’-এর বিরুদ্ধে যে লড়াই যুগে যুগে চালাচ্ছে বামপন্থীরা, আপাতত ভোটের স্বার্থে তা শিকেয় তোলা হচ্ছে? ব্রিগেড শেষে পাঠ করা হল দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাও! এও এক নজিরবিহীন ঘটনা। অতীতে এমনটা কখনও হয়নি।
সবশেষে উল্লেখ করতে হয় ভাষণের মাঝখানে মীনাক্ষীর নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহকপাট’-এর কয়েকটা লাইনের পর আটকে যাওয়ার প্রসঙ্গ। কিন্তু ভুল বা বিকৃত শব্দ না বলে মীনাক্ষী যে ভাবে সরাসরি ‘ভুলে গেছি’ বলে অসংখ্য মানুষের সামনে সহজ স্বীকারোক্তি করলেন, তা সত্যিই আলাদা করে তাঁকে চিনিয়ে দিল। সাধারণতঃ নেতা-নেত্রীরা এমন অকপটে সত্যিটা বলার সাহস দেখান না। তাঁরা অন্যভাবে অস্বস্তি এড়িয়ে যান, যা নিয়ে সমালোচনাও শুনতে হয়। কিন্তু মীনাক্ষী ছক ভাঙলেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ‘ইফ ইউ ক্যাননট আকসেপ্ট দ্য ব্লান্ডার, ইউ কেন নট রেকটিফাই দ্য সেম’।
এমনই নানা টুকরো টুকরো ঘটনায় ব্যতিক্রমী হয়ে রইল রবিবারের ব্রিগেড। ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে সিপিএম-বামেরা কতটা ঘুরে দাঁড়াবে, ব্রিগেডের জনজোয়ার কতটা বুথমুখী হবে, হলেও লালে আস্থা ফিরবে কি না, তা নিয়ে সংশয়, সন্দেহ থাকছে, থাকবে। কিন্তু তার মধ্যেই এমন নানা কারণে আলাদা করে মনে রাখার মতো হয়ে থাকবে মীনাক্ষীদের ব্রিগেড অভিযান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.