সরকারি সেন্সরশিপের ফাঁস এড়াতে সাদা এ-ফোর কাগজই সম্প্রতি হয়ে উঠেছিল চিনের মানুষের অস্ত্র- ‘এতে নিশ্চিতভাবেই কিছু লেখা নেই, কিন্তু আমরা জানি আসলে এখানে কী লেখা আছে!’ এই অভিনব আন্দোলন বিশ্বে প্রথম নয়, তবে চিনের সাম্প্রতিক এ-ঘটনার নামই হয়ে গিয়েছে, ‘এ-ফোর রেভোলিউশন’। লিখছেন সুস্নাত চৌধুরী
গত নভেম্বরে চিনের রাস্তায় দেখা যাচ্ছিল দলে-দলে মানুষ বিক্ষোভে শামিল। তাঁদের প্রতিবাদ ‘কোভিড ১৯’ নিয়ে পুনরায় শুরু হওয়া কড়াকড়ির বিরুদ্ধে। কিন্তু এই বিক্ষোভকারীদের মুখে কোনও সোচ্চার-স্লোগান ছিল না, হাতে ছিল না বর্ণময় প্ল্যাকার্ড। স্রেফ ফাঁকা এ-ফোর কাগজ হাতে নিয়ে প্রতিবাদে ‘সরব’ তাঁরা। বেজিং শুধু নয়, দেশের একাধিক শহরেই এই ছবি। সরকারি সেন্সরশিপের ফাঁস এড়াতে সাদা এ-ফোর কাগজই হয়ে উঠেছিল তাঁদের অস্ত্র- ‘এতে নিশ্চিতভাবেই কিছু লেখা নেই, কিন্তু আমরা জানি আসলে এখানে কী লেখা আছে!’ এমন অভিনব কায়দায় বিপ্লব-আন্দোলন বিশ্বে এই প্রথম নয়, তবে চিনের সাম্প্রতিক এ-ঘটনার নামই হয়ে গিয়েছে, ‘এ-ফোর রেভোলিউশন’। কালির আঁচড়টুকু ছাড়াই সামান্য একটা এ-ফোর শিটও তাহলে এত কথা বলতে পারে?
এ-ফোর (A4)-এর সাদা পাতায় লুকিয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ‘ডিমাই’ কিংবা ‘ক্রাউন’ সাইজের কাগজ থেকে বই তৈরির যে চলতি রীতি আমাদের, তার সঙ্গে সরাসরি ততটা যুক্ত না হলেও এই এ-ফোর কাগজই, আমেরিকা-কানাডার মতো দু’-চারটি ভূখণ্ড বাদে, বর্তমানে প্রায় সারা দুনিয়ায় ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গৃহীত। চিঠিপত্র লেখা থেকে বাড়ি বা অফিসের সাধারণ প্রিন্টার কিংবা ফোটোকপি করার যন্ত্র- এ-ফোরই সেখানে প্রধান ভরসা। কিন্তু কেন, কী কারণে কাগজটির এমন জনপ্রিয়তা?
লম্বায় ২৯৭ মিলিমিটার আর চওড়ায় ২১০ মিলিমিটার। আপাতভাবে দেখতে গেলে এ-কাগজের মাপটি বেশ খটমটোই। কিন্তু এমন মাপের আড়ালেই রয়েছে এর সুবিধার মূল কারণ। বিষয়টির উল্লেখ প্রথম নথিবদ্ধ হয় জার্মান পদার্থবিদ গেয়র্গ ক্রিস্টোফ লিখটেনবার্গের ১৭৮৬ সালের ২৫ অক্টোবর লেখা একটি চিঠিতে। বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিষয়ের লেখক ইয়োহান বেকমান-কে এই ঐতিহাসিক পত্রটি লেখা হয়। সেখানে লিখটেনবার্গ তাঁর এক ছাত্রকে একদা কষতে দেওয়া বীজগণিতের একটি সমস্যার কথা তুলে এনেছেন। সহজ অঙ্কটিতে জানতে চাওয়া হয়েছিল, একটি কাগজকে লম্বা দিকটিতে সমান দু’-ভাঁজ করে যদি এমন চার পৃষ্ঠার ‘ফোলিয়ো’ বানানো যায়, যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত গোটা কাগজটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাতের সঙ্গে সমান; তাহলে সেই অনুপাতটি কত ছিল? লিখটেনবার্গ আঁক কষে দেখিয়েছেন, উত্তর হবে ১:√২। এই অনুপাত বজায় থাকলে কাগজের অপচয় হয় সবচেয়ে কম।
একটি বড় কাগজ থেকে পর পর ভাঁজ করে প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্রতর মাপগুলিতে পৌঁছে যাওয়া যায়। ১৭৯৮ সালে ফরাসি পার্লামেন্টও কাগজের ছ’-রকমের মাপ প্রস্তাব করে, দেখা যায় তার মধ্যে পাঁচটিই রয়েছে হুবহু এই অনুপাতে। আজকের এ-ফোর কাগজের মধ্যেও লুকিয়ে আছে এই রহস্যই।
যদিও সুনির্দিষ্ট এ-ফোর মাপের বিষয়টি তখনও আসেনি। সেটির শুরুয়াতও জার্মানিতেই। তখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীতেই নানা অনুপাতের বিভিন্ন মাপের কাগজের চল ছিল। সেসব মাপাও হত মুখ্যত ইঞ্চিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধর শেষ দিক নাগাদ জার্মানরা বুঝে যায় নানাবিধ প্রমিতকরণ ও সংস্কারের আশু প্রয়োজন। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জার্মান প্রমিতকরণ সংস্থা বা ‘DIN’ (Deutsches Institut für Normung)। কাগজের মাপের ক্ষেত্রে মেট্রিক পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাগজের প্রমিত মাপ কী হওয়া উচিত, বছর কয়েকের মধ্যেই তা ঘোষণা করে এই সংস্থা। সেই ‘DIN 476’ থেকেই সামনে আসে এ-ফোর বিষয়ক ধারণা ও তথ্যাদি। এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক মান সংস্থার অধুনা প্রচলিত রীতি ‘ISO 216’. এ-ফোর বস্তুত ‘এ’ সিরিজ কাগজের একটি ভাগ। ওই ১:√২ অনুপাত বজায় রেখে ১ বর্গমিটার মাপের কাগজকে বলা হয় এ-জিরো। তারপর দৈর্ঘ্যের দিক বরাবর অর্ধেক ভঁাজ করলে মেলে এ-ওয়ান। এভাবেই ক্রমে আসে এ-ফোর; ধাপে ধাপে যাওয়া যায় আরও ছোট কাগজের দিকে। কিন্তু অনুপাত সব ক্ষেত্রেই সমান, ফলে কাগজের অপচয়ও শূন্য।
লন্ডনের হাইফেন প্রেসের কর্ণধার রবিন কিনরোস ২০০৯ সালে নেদারল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থাগারে ‘A4 and before: Towards a long history of paper sizes’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। কাগজের মাপের ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে লিখটেনবার্গের আঠারো শতকের ওই চিঠির প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, “In this letter Lichtenberg asked a question that I can take as a starting point for my investigations: ‘Are the rules of this proportion prescribed to the papermakers, or has the proportion just been disseminated through tradition? And where does this proportion come from– it surely hasn’t arisen by accident?” ‘ঘটনাচক্রে’ অকস্মাৎ কিছুই ঘটে না! ইতিহাসের সবটাই কার্য-কারণ সূত্রে বাঁধা। আর তাই আজকের এ-ফোরের পূর্বসূরির খোঁজে পিছিয়ে যেতে হয় এক সহস্রাব্দ! খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত পার্চমেন্ট ও কাগজের পুথি-পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করে একটি সমীক্ষা চালান অধ্যাপক জে. পি. গুমবার্ট। ২৩৯৫টি নমুনা খতিয়ে দেখে তিনি জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে ১:√২ অনুপাত বজায় রয়েছে। এ-ও দেখা যায় যে, চতুর্দশ শতকের কাছাকাছি এসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কাগজের পুথির মাপ দাঁড়াচ্ছে ৩০ সেমি x ২১ সেমি, অর্থাৎ প্রায় এ-ফোর কাগজই যেন!
কবি নিকানোর পাররা লিখেছিলেন, “কবিতায় সবকিছুই চলে।/ একটাই শুধু শর্ত, বলাই বাহুল্য:/ শাদা পাতার চেয়েও উৎকৃষ্ট হ’তে হবে তোমাদের।” (‘তরুণ কবিরা’, তরজমা: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)। মনে রাখা দরকার, শূন্য পাতা মানেই শূন্য নয়। তার সাদায় সাত রঙের মতো মিশে থাকে কত কী, গ্রন্থ সংস্কৃতির বিবিধ বৃত্তান্তও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.