শিশু পাচার ও শিশুদের উপর চলা যৌন নির্যাতন একটি সংগঠিত অপরাধ। পাচারচক্রের মেরুদণ্ড দুরমুশ করতে ‘দ্য ট্র্যাফিকিং অফ পার্সনস (প্রিভেনশন, প্রোটেকশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) বিল’ লোকসভায় ইতিমধ্যে পেশ হয়েছে। সংসদের চলতি বাদল অধিবেশনে এই বিল উপস্থাপিত হওয়ার কথা। এ বিষয়ে আইন প্রণীত হলে দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণা থেকে হাজার হাজার শিশু আশার আলোর দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। আলোকপাত করলেন কৈলাস সত্যার্থী
কী যে ভয়ংকর আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে ভারতের প্রান্তিক শিশুরা, তাদের নিয়ে লিখতে বসে আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭০ বছর অতিক্রান্ত হলে কী হবে, হাজার হাজার শিশু এখনও দাসত্বের শিকার। জোর করে তাদের শ্রমের কাজে জুতে দেওয়া হচ্ছে। কখনও সারল্যের সুযোগ নিয়ে তাদের পাচার করা হচ্ছে। কখনও বা তাদের উপর চলছে লাগাতার যৌন নির্যাতন। সময়ের পরিধিটাকে ছোট করে দেখলে, আরও হতাশার ছবি ফুটে ওঠে– দেশে প্রতি ঘণ্টায় আটজন শিশু নিখোঁজ হচ্ছে। যৌন নির্যাতনের বলি হচ্ছে চারজন। ঘণ্টাপিছু দু’জন করে শিশু ধর্ষণের কবলে পড়ছে। এভাবে তো চলতে পারে না। এ জিনিস থামাতে হবেই! একক চেষ্টায় কয়েক হাজার শিশুকে উদ্ধারের পর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, যথেষ্ট অপেক্ষা সয়েছে আমাদের সন্তানরা, আর নয়। সম্প্রতি কিছু শিশুকে দিল্লির একটি জিনস ফ্যাক্টরি থেকে উদ্ধার করা হয়। জানা গিয়েছিল, তিন বছর ধরে তারা এমন একটা ঘরে বন্দি ছিল, যেখানে একচিলতে সূর্যের রশ্মি ঢুকত না। বেরিয়ে আসার পর ঠিকমতো চোখ খুলতেই পারছিল না ওরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদের নাগাড়ে কাজ করতে হত। পুষ্টিকর খাবারদাবার পাওয়ার প্রশ্নই নেই। এতখানি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করতে করতে ওরা কেমন হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিল। যেন কতদিন থেকে রিকেটে ভুগছে। উদ্ধার হওয়া অল্পবয়সি মেয়েদের কাছে আমি শুনেছিলাম, কীভাবে গরু-মোষের থেকেও কম দামে ওদের বারবার বিক্রি করা হয়েছিল। আমাদের দেশের মেয়েদের আমরা ‘দেবী দুর্গা’-র রূপে পূজা করি! তারা কি এমন ব্যবহার প্রত্যাশা করে?
ভারত-সহ অন্যান্য দেশের শিশুদের উপর ঘটে চলা হিংস্রতার প্রতিবাদে প্রায় চার দশক ধরে আমার একতরফা যুদ্ধের পর, পৃথিবী জুড়ে শিশুদের জন্য নিরাপদ বিশ্বের দাবিতে চষে বেড়িয়ে, তাদের হারানো শৈশব ফিরিয়ে আনতে চেয়ে সংসদ ভবন আর আইনের দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে– আজ আমি ক্ষীণ হলেও আশার আলোকরশ্মি দেখতে পাচ্ছি। সেই আলো আমাদের এই গণতন্ত্র-ধামে শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থার আলো। ভারত শিগগিরই সেই বিচারব্যবস্থা নিয়ে হাজির হতে চলেছে, যা পাচারচক্রের মেরুদণ্ড দুরমুশ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ‘দ্য ট্র্যাফিকিং অফ পার্সনস (প্রিভেনশন, প্রোটেকশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) বিল’ লোকসভায় ইতিমধ্যে পেশ করা হয়েছে।
এই বিল সেই ১২ লক্ষ মানুষের নৈতিক জয়ের স্মারক, যাঁরা শিশু পাচার এবং শিশুদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার অঙ্গীকারে আমার সঙ্গে ১২০০০ কিলোমিটার ‘ভারত যাত্রা’-য় পা মিলিয়েছিলেন। ‘পাচার’-এর মতো জটিল ও সংগঠিত অপরাধের জন্য চাই এমন এক আইন যা পাচারকারীদের কাজের ধরনটাকে উপড়ে ফেলবে একেবারে গোড়া থেকে। যে আইনের দণ্ডাদেশ পাচার সংক্রান্ত ব্যবসার অর্থনৈতিক ভিতটাই নড়িয়ে দেবে, যা কিনা কোথাও গিয়ে ‘কালো টাকা’-র দুর্নীতিকে পুষ্টি দেয়। ‘মানুষ পাচার’ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অবৈধ ব্যবসা, যেখানে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! শিশু-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাচারের এক-একটা আনা ‘কালো টাকা’। এই বিলের সেই ক্ষমতা আছে যা অপরাধীদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, কোনওরকম বাইরের সাহায্য যাতে না পায় অপরাধীরা তার জন্য সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করা এবং সেই সঙ্গে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা, কঠোর কারাবাস এবং বিপুল পরিমাণ জরিমানা, আখেরে পাচারের দুষ্টচক্রটিকে উপড়ে ফেলবে সমূলে।
দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ কারণে আমি এই অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং বিলকে সমর্থন করি তা হল– আমার মতে, এটা উত্তরিত হতে পারে সেই দুর্লভ আইনে– যেখানে একটা বড় অংশ জুড়ে উদ্ধারকৃত মানুষদের সামাজিক মান্যতা, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের কথা যথোচিত গুরুত্বে বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধসম্বন্ধীয় কার্যধারা শুরু বা তার ফলাফল ঘোষণার আগেই উদ্ধারকৃতদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রথমবার, পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ফান্ড’-এর আহ্বানও জানানো হয়েছে এই বিলে। শিশু পাচার এবং তাদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কয়েক দিন আগের কথা। মাত্র ১১ বছর বয়সি একটি মেয়ে টানা কয়েক সপ্তাহ ধর্ষিত হয় চেন্নাইয়ের এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। ধর্ষকদের মধ্যে ছিল ওখানকার সিকিউরিটি গার্ড, ইলেকট্রিশিয়ান এবং কলমিস্ত্রি-সহ ১৭ জন পুরুষ। মধ্যপ্রদেশে ১৪ মাসের একটি একরত্তি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করে তার নিকটাত্মীয়। জাতির বিবেককে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য এটুকু তথ্যই কি যথেষ্ট নয়? মানবিকতা কি এর চেয়েও তলানিতে আরও নামতে পারে? জানা নেই। কিন্তু এটুকু স্পষ্ট– এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে শক্তপোক্ত প্রতিরোধমূলক আইনি কাঠামো নেই বলে। এর মোকাবিলায় ‘ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল’ (২০১৮) সংশোধিত হয়েছে। তা নাবালিকা ধর্ষণে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের কড়া এবং কঠোর শাস্তির বিধানে তৎপর। ভাবলেও আমি আতঙ্কিত হই, আমাদের দেশের কিছু রাজ্যে ধর্ষণের মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে ৫০ থেকে ১০০ বছর কেটে যায়। এই অস্বাভাবিক বিলম্ব কি ন্যায়বিচারের নীতিকে অস্বীকার করে না? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই নতুন আইনটি জারি হলে স্বল্প সময়ে বিচারের পথ সুগম করবে। সমস্ত রাজ্য ও জেলাগুলিতে বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে স্থাপন করা হবে বিশেষ ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ আদালত এবং ফরেনসিক পরীক্ষাগার। এপ্রিলের আগে প্রণীত বিধির পরিবর্তে এই বিল সংসদের বাদল অধিবেশনে ‘অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং বিল’-এর সঙ্গেই উপস্থাপন করা হবে।
গত বছর শিশু পাচার ও তাদের উপর যৌন নির্যাতন বন্ধের সমর্থনে দল ও মত নির্বিশেষে অধিকাংশ সাংসদই এগিয়ে এসেছিলেন। এবং কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ‘ভারত যাত্রা’-কে প্রসারিত করেন। এখন, এই বিল দু’টিকেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাস করাতে তাঁদের অগ্রণী হতে হবে। এই দু’টি বিল যেদিন আইনের আত্মার অন্তঃস্তল থেকে অক্ষরে অক্ষরে প্রণীত হবে, সেদিনই উদ্ধারকৃত আর তার পরিবার পাবে সঠিক বিচার এবং দেশের নাগরিকদেরও বিশ্বাস ফিরবে ভারতের শাসন-বিচার ব্যবস্থা এবং আইনে। এমনকী, এই আইন প্রণয়ন দেশের বিচারব্যবস্থা এবং নজরদারির হাল-হকিকতকেও সুনিশ্চিত করবে। বিগত ১০ বছরে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন ও সংশোধনে ভারত অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তাদের মধ্যে ‘রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট’ (২০০৯), ‘পিওসিএসও অ্যাক্ট’ (২০১২), ‘জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট’ (২০১৫), ‘নিউ চাইল্ড লেবার অ্যাক্ট’ (২০১৬) অন্যতম। এর পাশাপাশি, গত কয়েক দশকে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যস্তরে আমাদের মহামান্য আদালত নিখোঁজ শিশুর সন্ধান-সংক্রান্ত মামলায় মনে রাখার মতো কাজ করেছেন। পাচারের সংজ্ঞা, পাচার-বিরোধী ইউনিট তৈরি, প্লেসমেন্ট এজেন্সিদের রেজিস্ট্রেশন ও নিবন্ধীকরণ, আধুনিক দাসত্বের শিকার ও উদ্ধারকৃতদের যথাযথ মজুরি ফেরত দেওয়া-সহ ক্ষতিপূরণেও অাদালতের ভূমিকা অতুলনীয়।
একটা শক্তিশালী পাচার-বিরোধী আইনের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র যে শেষমেশ আইনি বিচারে ব্যর্থ হচ্ছে– তা আগেই উল্লেখ করেছি। পাচার-বিরোধী আইন ছাড়া প্রগতিশীল দেশের কল্যাণমূলক পরিকল্পনা এবং নীতি তাদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে প্রতিভাত করাবে না কিছুতেই। সুতরাং ব্যাপারটা খুবই পরিষ্কার। পাচারচক্রে যারা সবচেয়ে প্রভাবিত হয়, দুর্বিষহ যন্ত্রণা যারা ভোগ করে– সেই নিষ্পাপ শিশুদের জন্য চাই সুবিচার। যত তাড়াতাড়ি এবং মসৃণ পথে, সংসদে এবারের বর্ষাকালীন অধিবেশনে ‘দ্য ট্র্যাফিকিং অফ পার্সনস (প্রিভেনশন, প্রোটেকশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) বিল’ এবং ‘ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল’ পাস হবে, ততই তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে। যে কোনও আইনে আরও উৎকর্ষ সাধনের রাস্তা সবসময় খোলা থাকে। কল্পিত কোনও একুশে আইনের দেশে আমরা একটা বিষয়ে একটানা বাক্বিতণ্ডা করে গেলাম এবং শেষে সেই আইনেরই দ্বারস্থ হলাম, এমনটা হওয়া অনুচিত। শরীর ও মনে প্রভূত আঘাত আমাদের শিশুরা সহ্য করে এসেছে। আইনি ব্যবস্থার অপেক্ষায় তা আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার কোনও মানে হয় না। স্পষ্ট আইনি ব্যবস্থাই পারে সমতাবিধানের কথা বলতে।
লেখক শিশু-মানবাধিকার কর্মী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.