ছবি: সংগৃহীত।
১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল নয়টি বনাঞ্চল নিয়ে বাঘ বাঁচাতে পথ চলা শুরু করে ‘টাইগার প্রোজেক্ট’। টাইগার প্রোজেক্টের ৫০ বছর অতিক্রান্ত। গত বছরের ৯ এপ্রিল কর্নাটকের বন্দিপুর টাইগার রিজার্ভে ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্পের ৫০ বছর উদ্যাপন-সহ ২০২২ সালের বাঘ গণনার প্রতিবেদন উদ্বোধন করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বাঘ নিয়ে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কালো মেঘ কেটে যায়নি। লিখছেন অনুভব বেরা।
দৃশ্য এক, উত্তরপ্রদেশের পিলভিট জেলার একটি গ্রাম। সকালবেলায় অবাক করা দৃশ্য। একটি পাঁচিলের উপরে রোদ পোহাচ্ছে বাঘ মামা। আর এই দৃশ্য দেখতে ভিড় জমিয়েছে মানুষ। দৃশ্য দুই, পশ্চিমবঙ্গের কুলতলি থানার মৌপিঠ এলাকায় রাতভর বাঘের গর্জন আর লোকালয়ে বাঘের পায়ের ছাপে ভীত গ্রামবাসীরা গ্রাম পাহারা দিচ্ছে। দৃশ্য তিন, হিমালয়ের প্রায় ১২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ি জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এমনই বিস্ময়কর দৃশ্য ধরা পড়ল পূর্ব সিকিমের পাঙ্গোলাখা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের গোপন ক্যামেরায়। দৃশ্য চার, ২০২১-এর পর বক্সা বনাঞ্চলে ট্র্যাক ক্যামেরায় ধরা পড়ল বাঘ, বেশ কয়েকবার। প্রত্যেকটা ঘটনাই ঘটেছে ডিসেম্বর মাস জুড়ে। রসিকতা করে কেউ বলছেন, ক্রিসমাস ডে আর নতুন ইংরেজি বছর পালন করতে বাঘেদের এমন আচরণ। কেউ বলছেন দেশে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ-কেউ আবার বলছেন, বাঘেরা বনে ভাল নেই। এসবের পর্যালোচনা হয়তো হবে। কাকতালীয়ভাবে সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালে উদ্যাপিত হল ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্পের ৫০তম বর্ষ। এই আবহে আমরা ফিরে দেখব বাঘ বনে কেমন আছে।
১৯০০ সালের গোড়ার দিকে। তথ্য বলছে, ভারতের বনে তখন প্রায় ৪০ হাজার বাঘ ছিল। তারপর প্রায় ছয় দশক পার, ভারতের বন থেকে কার্যত উধাও হওয়ার জোগাড় যেন বা আমাদের ‘জাতীয় পশু’-র। অবস্থা এমন হল, ‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা’-র (আইইউসিএন) রেড ডেটা বুকে জায়গা জুটে গেল ভারতীয় বাঘের। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালে আইইউসিএন-এর দশম অধিবেশন বসল দিল্লিতে। সেখানে উঠল বাঘ-প্রসঙ্গ। অন্যদিকে ১৯৭২ সালে উদ্বিগ্ন ভারত সরকার এবং ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফফান্ড’ সংস্থা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে বন্যপ্রাণ ও বাঘ বাঁচাতে আলোচনায় বসল দিল্লিতে। ওই বছর ভারতে তৈরি হল ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল ডিরেক্টর কৈলাস সাঙ্গালা-র নেতৃত্বে নয়টি বনাঞ্চল নিয়ে বাঘ বাঁচাতে পথ চলা শুরু করল ‘টাইগার প্রোজেক্ট’ বা ব্যাঘ্র প্রকল্প। প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য, বাঘের ছত্রছায়ায় বাস্তুতন্ত্র তথা অন্যান্য হাজার হাজার প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
দেখতে দেখতে সেই টাইগার প্রোজেক্টের ৫০ বছর অতিক্রান্ত। বর্তমানে ভারতে ৫৩টি টাইগার রিজার্ভ। সব ঠিকঠাক চললে কিছু দিনের মধ্যে ৫৪তম টাইগার রিজার্ভ হতে চলেছে ‘দিবাং ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি’। গত বছরের ৯ এপ্রিল কর্নাটকের বন্দিপুর টাইগার রিজার্ভে ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্পের ৫০ বছর উদ্যাপন ও ২০২২ সালের বাঘ গণনার প্রতিবেদন উদ্বোধন করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতিবেদনে স্বাভাবিকভাবে ব্যাঘ্র প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে। যা থেকে জানা যায়, ভারত বিশ্বের ৭০% বাঘের অধিকারী। এখন ভারতের বাঘের আবাসস্থল ৩ লাখ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত। এতে ১০ হাজার থেকে ১৫,০০০ বাঘ থাকতে পারে ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে এটি বিরাট সাফল্য। কারণ, নেপাল ছাড়া অন্যান্য বাঘের দেশের অবস্থা হতাশাজনক। সে-জায়গায় ১৯৭০ সালের পরবর্তী কালে বাঘের অস্তিত্বকে ভারত পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
সাফল্য যেমন এসেছে, তেমনই আছে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। দেশে বাঘের সংখ্যা বাড়লেও বিপদ কিন্তু এখনও কমেনি। চোরাশিকার, বনের বিনাশ ও পাশাপাশি অবস্থিত অরণ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে জিনপুল একমাত্রিক হয়ে যাওয়া হয়ে উঠেছে বাঘের নতুন বিপদ। হিসাব বলছে, ২০০৬-এ ভারতের বাঘের সংখ্যা ছিল ১,৪১১। এখন বাঘের সংখ্যা ৩১৬৭। শেষ ১৬-১৭ বছরে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ১৭৫৬। যা শতাংশের বিচারে খুবই কম। এই বৃদ্ধি নিয়ে কি খুব গর্ব করা যায়? তাছাড়া, বাঘের সংখ্যা সমস্ত সংরক্ষিত এলাকায় সমানভাবে বাড়েনি। পশ্চিমঘাট অঞ্চলে কর্নাটক, তামিলনাড়ু এবং সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া অঞ্চলে তাডোবা, মেলঘাট, পেঞ্চ, কানাহা, এবং বান্ধবগড়-সহ করবেট, দুধওয়া, কাজিরাঙায় বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলেও ছত্তিশগড়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির বিস্তৃত বাঘের আবাসস্থলগুলির অবস্থা শোচনীয় এবং সেগুলিই মূলত চোরাশিকারিদের ঘঁাটি।
২০১৭-র ‘ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’-র সমীক্ষা বলছে, আমাদের দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ ২৩ শতাংশের কিছু বেশি। অতি ঘন বনাঞ্চল মাত্র ২.৯৯ শতাংশ। প্রতি বছর উন্নয়নের নামে সড়ক, খনি, রেলপথ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটনকেন্দ্রের পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ বন ধ্বংস করা হচ্ছে। দেশের বন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী ২০১০-’১৪, এই চার বছরে কেবল বাঘের রাজ্যেই অর্থাৎ টাইগার রিজার্ভ অরণ্যগুলিতে ৭৫ লক্ষ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মধ্যভারতীয় বাঘের বিচরণক্ষেত্র তথা করিডর। উল্লেখ্য, বাঘের মধ্য ভারতীয় বিচরণক্ষেত্র ৮টি রাজ্য জুড়ে ২৫টি বাঘ সংরক্ষণ অরণ্য এবং বাঘের উপস্থিতি-সহ কম-বেশি ৪৩টি বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ বনাঞ্চল আছে। বন ধ্বংসের কারণে তাদের বাসস্থান শুধু নষ্ট হচ্ছে না, পাশাপাশি দুটো মধ্যবর্তী বনাঞ্চলের মধ্যে করিডরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বাঘ টেরিটোরিয়াল প্রাণী। মায়ের থেকে আলাদা হওয়ার পর প্রতিটি বাঘের নিজস্ব এলাকা বা পছন্দমতো এলাকা দরকার হয়ে পড়ে। পছন্দমতো এলাকা না পেলে এলাকা খুঁজতে ঘুরতে ঘুরতে যেতে হয় বন থেকে বনান্তরে। তাতে মানুষের সঙ্গে সংঘাত কিংবা অন্য বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাত হয়। মৃত্যুও হয়। মহারাষ্ট্রর ইয়াভাতমল জেলার পানধারখাওয়া জঙ্গলে বাঘিনি অবনির মৃত্যু তো বাঘ ও মানুষের সংঘাতেই ঘটেছিল। এছাড়া কখনও কখনও নিজের জায়গা খুঁজতে অরণ্যের প্রান্তে চলে এলে বা বেরিয়ে পড়লে চোরাশিকারিদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে পড়ে। বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে।
পরিসংখ্যান বলছে ২০১০-এ ৩০টি, ২০১১-য় ১৩টি, ২০১২-য় ৩২টি, ২০১৩-য় ৪২টি বাঘ মরেছে চোরাশিকারিদের হাতে। অরণ্যের সংকোচনের জন্য সম্প্রতি পূর্ব সিকিমের পাঙ্গোলাখা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যে (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১৯৪২ ফুট) রাখা গোপন ক্যামেরায় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলেছে। বন্যপ্রাণ গবেষকদের মতে, এখনও পর্যন্ত এটাই দেশের মধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সর্বোচ্চ আবাসস্থল। এখান থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে, সমতলে বিপন্ন হতে হতে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাঘ উত্তরের উচ্চ পাহাড় জঙ্গল বেছে নিয়েছে অভিযোজনের মাধ্যমে।
বন-ধ্বংসের কারণে অরণ্যগুলির মধ্যে করিডর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাঘেরা যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে বাস করছে। এর অবশ্যম্ভাবী বিপদ হল জিনপুল একমাত্রিক হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ কোনও একটি এলাকার বাঘের সম্মিলিত জিন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বৈচিত্র কমে যাওয়া। জিন বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র যে কোনও প্রজাতিকে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। নানা বংশের বাঘের মধ্যে যথেচ্ছ প্রজননের মধ্যে দিয়েই কেবল জিনবৈচিত্র বাড়তে পারে, কিন্তু সেজন্য চাই দূরদূরান্তের বাঘেদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ।
হালে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া অরণ্যে এই জিনপুল বাড়ানোর কোনও সুযোগ থাকছে না। প্রবল বলশালী বাঘও আকস্মিক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাতে পারে। কারণ হয়তো তার জিনসমষ্টিতে সেই রোগের লড়াই করার উপাদানগুলি পৌঁছতে পারেনি। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ৫০টিরও বেশি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে মধ্যপ্রদেশে ১৮টি, আর মহারাষ্ট্রে ৮টি। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ অজানা। আশঙ্কা, আকস্মিক কোনও রোগেই বাঘের এহেন অপমৃত্যু।
বাঘ সংরক্ষণের উদ্যোগের দরুন ভারত কার্বন বেনিফিটের কারণে ৭৬৯ কোটি টাকা উপার্জন করেছে। তেমনই টাইগার রিজার্ভ অঞ্চলে টাইগার সাফারি থেকে গড়ে উঠেছে বাঘ পর্যটন। তা থেকে দেশের বিদেশি মুদ্রায় আয় হচ্ছে বিপুল। কর্মসংস্থান থেকে দেশের বিভিন্ন ধরনের উপার্জনের ব্যবস্থা এরূপ পর্যটন থেকেই হয়। কিন্তু যে কোনও বন্যপ্রাণের পর্যটনের বিকাশের জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটা হল বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান ও মানবিকতা। সেগুলোর বর্তমানে প্রবল ঘাটতি।
১৯৭৩ সালে ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রথম ডিরেক্টর কৈলাস সাঙ্গালা বলেছিলেন, বাঘের এলাকাগুলিতে কিছু করতে হবে না, আর কাউকে কিছু করার সুযোগও দেওয়া উচিত নয়। দেখবে তাতেই বাঘগুলো বেঁচে যাবে। তাঁর কথাগুলি আজকের পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ যেভাবে টাইগার প্রোজেক্ট অঞ্চল ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র, রাস্তাঘাট ও খনি সম্প্রারণের কাজ চলছে, তাতে বিঘ্নিত হচ্ছে বাঘের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
৫০ বছরের টাইগার রিজার্ভের অবস্থা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ব্যর্থতা নিরসনের প্রয়াস। আত্মতুষ্টিতে নয়, বরং সুপরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক পরিচালন ব্যবস্থার মাধ্যমেই সুরক্ষিত থাকতে পারে বাঘের জীবন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক শিক্ষক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.