সাতের দশকে, কলকাতার নিজস্ব ৫৫ লক্ষ জনসংখ্যার সঙ্গে, শিয়ালদহ ও হাওড়া হয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ অতিরিক্ত মানুষের ভিড় শহরের উপরে পড়তে থাকে, রোজ। অভ্যন্তরীণ এই ভিড়ের মোকাবিলায় আবির্ভূত হয় চক্ররেল। লিখলেন অভিজিৎ সাহা।
প্রিন্সেপ ঘাট রেল স্টেশনে সম্প্রতি কলকাতার চক্রবেড় রেল বা চক্ররেলের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হল। ১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া এই পরিষেবার মাধ্যমে শহরতলির অফিসযাত্রীরা অনায়াসে ও সামান্য খরচে শহরের অভ্যন্তরে পৌঁছে যাওয়ার অবকাশ পেয়েছিল। কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের পরিবহণ মানচিত্রে চক্ররেলের ভূমিকা এখনও প্রাসঙ্গিক, অনস্বীকার্য।
পূর্ব ভারতের অন্যতম কর্মচঞ্চল ও সম্ভাবনাময় শহর হিসাবে স্বাধীনোত্তর পর্বে কলকাতার অভাবনীয় প্রসার ঘটে। দেশের শতকরা ৩০ ভাগ কর আদায় এবং ৩০ ভাগ ব্যাঙ্কিং কাজকর্মের ক্ষেত্রে কলকাতার ভূমিকা ছিল অবিসংবাদী। জাতীয় জীবনে কলকাতার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বৃদ্ধির ফলে শহরের অভ্যন্তরে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। শহরের নিজস্ব জনস্ফীতির সঙ্গে শহরতলি থেকে আগত জনপ্রবাহ পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। লক্ষণীয়, দেশভাগের অব্যবহিত পরেই উদ্বাস্তু জনস্রোতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এই শহরকে। অথচ, বর্ধিত জনসংখ্যার যাতায়াতের উপযোগী সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এই শহরের ছিল না। উপরন্তু শহরের অভ্যন্তরীণ পরিবহণ ব্যবস্থার উপরে ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি পায়।
লক্ষণীয়, ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলগুলি কোনওভাবেই কলকাতার প্রভাব-মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নিজস্ব আর্থিক বিকাশকে তরান্বিত করতে পারেনি। স্বাভাবিক নিয়মেই স্বাধীনতার পরেও রুজি-রোজগারের আশায় শহরতলি থেকে কলকাতায় জনস্রোতের অবিরাম প্রবাহ চলতেই থাকে। সাতের দশকে, কলকাতার নিজস্ব ৫৫ লক্ষ জনসংখ্যার সঙ্গে, শিয়ালদহ- হাওড়া হয়ে আগত প্রায় ১৩ লক্ষ অতিরিক্ত মানুষের ভিড় শহরের উপরে উপচে পড়তে থাকে, রোজ। এই জনসংখ্যার সিংহভাগের গন্তব্য ছিল ডালহৌসি-সংলগ্ন অফিসপাড়া অঞ্চল, যা মূলত কলকাতার প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডর ভরকেন্দ্র রূপে পরিচিত।
শহরের মধ্যস্থলে, বিরাট জনসংখ্যার একমুখী চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকলে, তা বিশেষজ্ঞদের মনেও চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। ইতিমধ্যে, কলকাতার রাজপথে শ্লথগতির যানবাহনের আধিক্য, যানজটের বর্ধিত সমস্যা, অপ্রতুল রাস্তাঘাট, রাজপথে দুর্ঘটনার ঘনঘটা, ভিড় বাসে-ট্রামে অস্বাস্থ্যকর যাতায়াত নাগরিক জীবনের দুর্বিষহ ছবিটাকে যথেষ্ট স্পষ্ট করে তুলছিল। এহেন সমস্যাকীর্ণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়টি যে জাতীয় স্বার্থের জন্যই জরুরি ছিল, ১৯৬৮ সালে তা তদানীন্তন কেন্দ্রীয় জাহাজ ও পরিবহণ মন্ত্রী কস্তুরী রঙ্গ রাও পর্যন্ত স্বীকার করেন।
কলকাতার বর্ধিত পরিবহণ সংকট থেকে উত্তরণের যে তৎপরতা মধ্য ছয়ের দশকে লক্ষ করা গিয়েছিল, চক্ররেলের বিস্তার সেই বৃত্তটাকে অনেকটা পূর্ণতা দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১৪ সালে সর্বপ্রথম ‘মার্জ ও ম্যাকেলন’-এর রিপোর্টে শহরতলি এলাকা ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রকে রেলপথে সংযুক্ত করার কথা উল্লিখিত হয়েছিল। ১৯২৪ সালে, তঁাদের অন্য একটি রিপোর্টে, শহরতলির সঙ্গে সরাসরি রেলপথের মাধ্যমে, শিয়ালদহ ও হাওড়ার মতো দুই প্রান্তীয় ও গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনকে যুক্ত করার কথা বলা হয় এবং ডালহৌসি স্কোয়্যারকে এই পথের সংযোগকারী স্টেশন রূপে তুলে ধরা হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালে ‘স্যর’ পি. গিনওয়ালার সভাপতিত্বে গঠিত ‘টার্মিনাল ফেসিলিটি কমিটি’-র প্রস্তাব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই কমিটি তঁাদের প্রস্তাবিত রিপোর্টে চিৎপুর ইয়ার্ডের মালবহনকারী রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পোর্ট কমিশনারের রেলপথকে নতুনভাবে ব্যবহার করে হুগলি নদীর পার বরাবর বাগবাজার থেকে বজবজ লাইনের মাঝেরহাট এবং উল্টোডাঙার উত্তর প্রান্তের সঙ্গে বালিগঞ্জের দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে সর্বমোট ২১ মাইল পথে চক্ররেল বিস্তারের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছিল।
দেশভাগ পরবর্তী আর্থ-রাজনৈতিক আবহে, ১৯৫৩ সালে, গঠিত এস. এন. রায় কমিটি পূর্ববর্তী কমিটির পর্যবেক্ষণকে মোটামুটি সিলমোহর দিলেও, চিৎপুর ইয়ার্ডকে দমদম সংলগ্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে টার্মিনাল কমিটির প্রস্তাব খারিজ করেছিল, এবং ভূতল বরাবর চক্ররেলের সম্প্রসারণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বস্তুত, রায় কমিটির সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহমত রেখে ১৯৫৪-’৫৬ সালে এস. সরঙ্গপানি শহরতলির রেলপথ ব্যবস্থার বৈদ্যুতিকরণের উপর জোর দিলে, রেল কর্তৃপক্ষ তা দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ করে। তবে, বিবিধ প্রতিবন্ধকতা ও বিরুদ্ধ-মতের জন্য দীর্ঘ সময় চক্ররেল প্রকল্পকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। যেমন, পণ্য পরিবহণ টার্মিনাল ও গুদাম চত্বর হিসাবে চিৎপুর ইয়ার্ডের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে প্রাথমিক অন্তরায় হয়ে দঁাড়ায়। এই পথে চক্ররেল চললে যাত্রী পরিবহণে অনর্থক বিলম্ব হওয়ারও সুযোগ ছিল। অন্যদিকে, হুগলি নদীর তট-বরাবর পোর্ট কমিশনারের রেলওয়ের লাইনে বৈদ্যুতিন ট্রেন চলাচল করলে, যে-কম্পন তৈরি হবে, তা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এমনকী বিদ্যমান রেললাইনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। এই মতও উঠে আসে যে, পদব্রজে হুগলি নদীতে স্নান ও অন্যান্য কাজে আসা ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের গতিবিধি নতুন রেল-নকশায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তঁাদের জন্য উপযুক্ত আন্ডারপাসের ব্যবস্থা না-হওয়া পর্যন্ত এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
ছয়ের দশকের গোড়া থেকে কলকাতার নগরোন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘সিএমপিও’-র একাধিক রিপোর্টে মফস্সল ও শহরতলি থেকে আগত বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড়ে কলকাতার যানব্যবস্থার দৈন্যর ছবিটা উঠে আসতে থাকে। ১৯৬৮ সালের রিপোর্টে ‘সিএমপিও’ কলকাতার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত দমদম থেকে পূর্ব প্রান্তের নব্য গঠিত সল্টলেক টাউনশিপ হয়ে সুদূর দক্ষিণের বালিগঞ্জ এবং পশ্চিমে প্রিন্সেপ ঘাটের মধ্যে একটি ‘রিং রেলওয়ে’ বা চক্ররেলের পক্ষে জোরালো মত পেশ করেছিল। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণ মন্ত্রী শৈলকুমার মুখোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে তদানীন্তন রেল মন্ত্রী এস. কে. পাটিলের কাছে যে-সুপারিশ রাখা হয়েছিল, তাতে কলকাতার পরিবহণ সংকটের মোকাবিলায় চক্ররেলকেই একমাত্র ‘আদর্শ’ সমাধান রূপে ব্যাখ্যা করা হয়। আবেদনে এ-ও বলা হয় যে, অবিলম্বে মাপজোখের কাজ শুরু করে এই প্রকল্পকে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ যেন নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে চক্ররেলের পরিবর্তে ভূগর্ভস্থ মেট্রোর সম্ভাবনা নিয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস লক্ষ করা গেলেও, কলকাতার রাজনৈতিক মহলে, চক্ররেলের বিস্তারের বিষয়েই আস্থা রাখা হয়েছিল। এই দাবি উঠেছিল যে, মেট্রো রেলের কাজ শেষ হতে যেখানে ১০-১৫ বছর সময় লেগে যেতে পারে, চক্ররেল পরিষেবা সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানেই চালু করা সম্ভব হবে। এছাড়া, মেট্রোর বিস্তারের ক্ষেত্রে যেখানে প্রতি মাইলে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, চক্ররেলের ক্ষেত্রে সেই খরচ দঁাড়াবে প্রতি মাইলে মাত্র দু’কোটি। যদিও ছয় ও সাতের দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকে বিশ বঁাও জলে ঠেলে দেয়।
শেষ পর্যন্ত, ১৯৮০-’৮২ সালে পূর্ববর্তী প্রস্তাবসমূহের মোটামুটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সর্বমোট ১৭টি স্টেশনের মধ্যে চক্ররেল চলাচলের ব্যবস্থায় সিলমোহর পড়ে। এবং এই যাত্রাপথে ফেয়ারলি প্লেস বা অধুনা বিবাদি বাগ স্টেশন এবং বড়বাজারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়, চিৎপুর ইয়ার্ডকে যাত্রীবাহী স্টেশনে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৯০ সালে এই যোগাযোগ-পথকে দমদম জংশনের সঙ্গে যুক্ত করা হলে উত্তর শহরতলির সঙ্গে শহরের অভ্যন্তরীণ পরিবহণ ব্যবস্থার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল। কলকাতার জনজীবনের বিস্তারের নিরিখে এবং অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের পরিবর্তিত চরিত্রের কথা বিবেচনায় রেখে, চক্ররেলের বিস্তারকে, আটের দশকের একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসাবে দেখা যুক্তিযুক্ত হবে। বর্ধিত পরিবহণ সংকট নিরসনে ও শহরের ভিতরের আইন-শৃঙ্খলায় স্থিতাবস্থা আনার ক্ষেত্রে যা দিক-নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিল।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.