Advertisement
Advertisement

Breaking News

TMC

বাংলায় সিগন্যাল গ্রিন… তৃণমূলের বাজিমাতের এক ডজন রহস্য

এটা শুধু ২০২৪ সালের লোকসভার ফল নয়, এটা যেন ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের একটি ভূমিকার মঞ্চ।

12 reasons behind TMC's massive win in Bengal

ফাইল ছবি।

Published by: Paramita Paul
  • Posted:June 6, 2024 10:42 am
  • Updated:June 6, 2024 10:45 am  

কুণাল ঘোষ: এক্সিট পোল নামক পরিকল্পিত গল্পগুচ্ছকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলায় তৃণমূলের এমন ঝড় প্রত‌্যাশিতই ছিল। প্রচারপর্বের শুরু থেকেই প্রকাশ্যে বলে এসেছি বা পোস্ট করেছি, ‘তৃণমূল ৩০ পার’। যাঁরা বিশ্বাস করতে পারেননি, সমস‌্যাটা তাঁদের। ঠিক কোন কোন ফ‌্যাক্টর এতে কাজ করল এবং তৃণমূল ২৯-এ পৌঁছল (আরও তিন-চারটি অল্পের জন‌্য বা অন‌্য কারণে হাতছাড়া), তার বিশ্লেষণও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

(এক) মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়ের উন্নয়ন এবং পরের পর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। একদিকে রাস্তা, জল, আলোর পরিকাঠামো, অন‌্যদিকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে স্বাস্থ‌্যসাথী। মানুষ পরিষেবা পেয়েছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন। মানুষের ধারণা, এই পরিষেবা অক্ষুণ্ণ রাখতে মুখ‌্যমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী করতে হবে। অন‌্য কোনও শক্তি বাড়াবাড়ি করলে এইসব বন্ধ হয়ে যাবে।

Advertisement

(দুই) বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা। টাকা আটকে রাখা। একশো দিনের কাজ করিয়েও টাকা বন্ধ করে বিজেপির আস্ফালন। উলটোদিকে মোক্ষম সময়ে এই টাকা বরাদ্দ করতে মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়ের নিজের ঘোষণা। এনিয়ে মুখ‌্যমন্ত্রীর ধরনা বা অভিষেকের দিল্লি অভিযান, রাজভবনে ধরনা-সহ কর্মসূচিগুলিতে মানুষকে ইনভলভড‌ করে নিয়ে তার পর রাজ্যের তরফ থেকেই সুরাহার হাত বাড়ানোটা মানুষ গ্রহণ করেছেন। বঞ্চনার ইস্যুতে প্রত‌্যাখ‌্যাত হয়েছে বিজেপি।

(তিন) তৃণমূল কংগ্রেসের বুথভিত্তিক সংগঠন, সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধি, লোকবল। অন‌্যদিকে বিজেপির সংগঠনহীনতা শুধু মিডিয়া বা সোশাল মিডিয়ার উপর নির্ভরতা। এলাকায় ভোটকাঠামো না থাকা।

(চার) বিজেপির নেতারা বাংলার বিরুদ্ধে মূলত কুৎসা করেছেন। ব‌্যক্তিগত আক্রমণ। বাংলার উপকার করেননি। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভোটপ্রচারে এলেও স্থানীয় কোনও প্রভাব ছিল না। বিজেপির এই কুৎসা এবং ঔদ্ধত্যের সঙ্গে এজেন্সি-রাজনীতিটা মানুষ প্রত‌্যাখ‌্যান করেছে।

[আরও পড়ুন: রাম রাজনীতিতেই ভরাডুবি! মোদিকে টক্কর না নেওয়ার হুঁশিয়ারি পুরীর শঙ্করাচার্যের]

(পাঁচ) বিজেপি অভ‌্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ঝাঁজরা। নব‌্য এবং আদির গোলমাল প্রায় সর্বত্র। যে গোষ্ঠী এখন ক্ষমতায় তারা ইচ্ছেমতো প্রার্থী দিয়েছে, আসন বদল করেছে। পুরনোদের উপর নতুনরা দাদাগিরি চালিয়েছে। এতে প্রতিটি আসনেই উলটো চোরাস্রোতের খেলা চলেছে। নিট ফল পরের পর আসনে হার।

(ছয়) মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠিন পরিশ্রম। মুখ‌্যমন্ত্রী পরের পর সভা এবং পায়ে হেঁটে সত্যিই পদযাত্রা করেছেন। এসবের প্রভাব বিরাট। পাশাপাশি, অভিষেকের সভা, রোড শো এবং ভোট ম‌্যানেজমেন্টের কৌশল, আইপ্যাককে অস্ত্র হিসাবে ব‌্যবহার করা, প্রতিটি পদক্ষেপই কার্যকর হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু আসনে নতুন মুখ বাছাইও যথাযথ প্রমাণিত হয়েছে।

(সাত) রাজ্যের জেলাভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক জনবিন‌্যাস এবং সমস‌্যাগুলির প্রশ্নে একেবারে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও প্রচারে গিয়েছে তৃণমূল। তাতে সাড়া মিলেছে। বিজেপির ক্ষেত্রে এর কোনও পরিকল্পনার ছাপ ছিল না।

(আট) বাংলার চিরকালীন ঐতিহ‌্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে এখনও খাপ খাওয়াতে পারেনি বিজেপি। মাছে-ভাতে বাঙালির এই রাজ্যে কখনও রটেছে মাছ-মাংস বন্ধ করা হবে, কখনও খবর হয়েছে বিজেপিশাসিত রাজ্যের পাঠ‌্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাদ বা এই ধরনের আরও বিষয়গুলি বিজেপিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বিজেপি এখনও বাংলার বা বাঙালির হতে পারেনি।

[আরও পড়ুন: দেবতার গ্রাস! উত্তরকাশীতে প্রকৃতির রুদ্ররোষে প্রাণ হারালেন ৯ ট্রেকার, চলছে উদ্ধারকাজ]

(নয়) বিরোধীরা চাকরি বা সন্দেশখালি ধরনের ইস্যুকে হাতিয়ার করলেও মানুষ তাতে সাড়া দেননি। বিতর্কিত চাকরিপ্রার্থীদের শাস্তির বদলে গোটা প‌্যানেলের চাকরি খাওয়ার হুমকি দিতে গিয়ে নিজেদের শত্রু বাড়িয়েছে বিরোধীরা। আর সন্দেশখালির নারী নির্যাতন যে চক্রান্ত, সেটা গঙ্গাধর কয়ালের ভিডিও থেকেই মানুষ বিশ্বাস করে নিয়েছেন। সিএএ নিয়ে বিজেপি যে কথা বলতে গিয়েছিল, মুখ‌্যমন্ত্রী তা কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব বা সাম্প্রদায়িক ঘরানার প্রচার বাংলাকে বিরক্ত করেছে। তৃণমূলের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান মানুষ পছন্দ করেছে।

(দশ) তৃণমূলকে চাপ দিতে কেন্দ্রের রাষ্ট্রশক্তি ব‌্যবহার, এজেন্সির অপব‌্যবহার, লাগাতার ব‌্যক্তি আক্রমণ ও কুৎসা, আদালতের একাংশের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা– এই গোটা বৃত্তটির জবাবে তৈরি হয়েছে এক আত্মবিশ্বাসী বঙ্গ-অস্মিতা। তার পরিপূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে ভোটে।

(এগারো) বাম এবং কংগ্রেস নিজেদের ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ‌্যতা প্রমাণ করতে ব‌্যর্থ। মানুষের ধারণা, এদের ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়া। তাই অধীর চৌধুরী, মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীদের হারতে হয়। চূড়ান্ত খারাপ ফল হয় সৃজন, দীপ্সিতা, প্রতিক উরদের। কংগ্রেস একটি আসন পেলেও বামেরা এখনও শূন‌্য। শুধু মিডিয়া, সোশাল মিডিয়া এবং বড় বড় কথা বললে যে মানুষের সমর্থন মেলে না, এটা তাঁরা এখনও বুঝছেন না। টিভি চ‌্যানেলগুলির টক শোতে সব দলের কোটায় হাঁকাহাঁকির সুযোগ পাওয়া মানেই ভোট পাওয়া নয়, এই বাস্তব সত‌্যটা তাঁদের বোধবুদ্ধির
বাইরে। সিপিএমের নব‌্য দু-একজন অতিচালাক টিভি চ‌্যানেলের বিপ্লবী সংলাপ ইউটিউবে তুলে লাইক বাড়িয়ে কিছু টাকা কামাতে পারে, কিন্তু
লাইকদাতারাও ভোটে এইসব ফেরেব্বাজিকে ডিসলাইক করেছেন।

(বারো) গোটা দেশেও একটা বিজেপি বিরোধী হাওয়া কাজ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পারফরম‌্যান্সে মানুষ যে খুশি নন, মোদি ম‌্যাজিক যে আগের থেকে কার্যকারিতা কমিয়েছে, বিজেপি একক সংখ‌্যাগরিষ্ঠতার জায়গায় নেই, এটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এগজিট পোলের আয়োজকরা যে কোনও কারণেই হোক এগুলি অস্বীকার করলেও আমরা যারা দৈনন্দিন জীবনে মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করি, তাদের কাছে ছবিটা নিশ্চিত ছিল। মুখ‌্যমন্ত্রীও তাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে আসছিলেন বিজেপি একক গরিষ্ঠতা পাবে না। আমার ব‌্যক্তিগত ধারণা, মুখ‌্যমন্ত্রীর প্রস্তাব মেনে অনেক আগে থেকেই যদি ইন্ডিয়া জোট যৌথ কর্মসূচি করত, রাজ‌্যভিত্তিক কর্মসূচি নিত, আসন সমঝোতায় বাস্তবমুখী কাজকর্ম করত, তাহলে তারা সরকার গড়ার সরাসরি রায়টা জনগণের কাছ থেকে পেয়ে যেত।

এই কারণগুলির উপর দাঁড়িয়ে এবার বাংলায় তৃণমূলের এই বিপুল জয়। এটা শুধু ২০২৪ সালের লোকসভার ফল নয়, এটা যেন ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের একটি ভূমিকার মঞ্চ। বিজেপি, সিপিএম বা কংগ্রেস নেতারা এই জনমতকে সহ‌্য করতে না পেরে যেসব মন্তব‌্য করছেন, তাতে মানুষকে ছোট করা হচ্ছে, মানুষ আরও বিরক্ত হচ্ছে, এখন বিরোধীরা এসব করলে আরও বেশি করে ডুববেন। তার বদলে ফলাফলের যথাযথ বিশ্লেষণ চলতে থাকুক। এখানে মিডিয়ারও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। জনমত একদিকে যাচ্ছে আর আলোচনার অন‌্যদিকে অভিমুখ, এটা কি বিশ্বাসযোগ‌্যতা বাড়াবে?

সোশ‌্যাল মিডিয়ায় কিছু কিছু ইউটিউবার সাংবাদিকতার নামে যা করলেন, তাকে অসভ‌্যতা বলে। ২০১১ সালের পরিবর্তনের আগে আমরাও তৎকালীন সরকারের বহু কাজের তীব্র সমালোচনা করেছি। কিন্তু তারও একটা যুক্তি বা ভাষা থাকে। আমরা সমালোচনা করলাম, অথচ ভোটে সরকারই জিতে গেল, তাহলে আর সাংবাদিকতায় মানুষের মন কী বুঝলাম? ২০১১ সালের ভোটের আগে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর একটি বিজ্ঞাপন ছিল ‘বাংলায় সিগন‌্যাল গ্রিন’। সঙ্গে ট্রাফিক সিগন‌্যালের বাতির ছবি। এখনও যা বুঝছি, সিগন‌্যাল গ্রিনই আছে। ইস্যুভিত্তিক বিশ্লেষণ বা সমালোচনা বা বিরোধিতা, আর সামগ্রিকতায় তার কী প্রভাব পড়ছে, সেই ফারাকটা ধরতে না পারা সাংবাদিকতা বা সমীক্ষার ব‌্যর্থতা। এগুলো নিয়েও ভাবার সময় এসেছে, ভাবা উচিত।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement