রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: উস্কোখুস্কো, অবিন্যস্ত, ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটাকে দেখলে ঠিক পেসার-পেসার মনে হয় না। রোগা-পাতলা ছেলেটার শরীরী ভাষাও যেন কেমনতর! আগুনে পেসার-সুলভ সেই ঝাঁঝটাই নেই। বাঘা ব্যাটারকে আউট করার পরেও তার দিকে হিংস্র ধেয়ে যেতে পছন্দ করেন না বিশেষ। কড়া ‘সেন্ড অফ’ প্রভৃতির তো বালাই-ই নেই। এবং এ হেন বিবর্ণ উৎসব-ভঙ্গিমার কারণও বড় অদ্ভুত। যে ব্যাটার আউট হল, সে তখন মনখারাপে ডুবে যে! তার সামনে তখন উদাত্ত লম্ফঝম্ফ করা যায় কখনও?
লিখলাম না, উস্কোখুস্কো, অবিন্যস্ত, ঝাঁকড়া চুলের হাসান মেহমুদ পেসার হয়েও ঠিক পেসার নন!
উঁহু, উর্বর কল্পনাশক্তির আশ্রয়ের সাহচর্যে এ লেখার বেড়ে ওঠা, ভাববেন না। হাসান মেহমুদ সত্যিই আলাদা। অন্য রকম। আর পাঁচজন পেসারের সঙ্গে যাঁর চরিত্রগত সাযুজ্য বিশেষ নেই। থাকলে একই ইনিংসে রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলির মতো ভুবনবিখ্যাত দুই ব্যাটিং-বীরের উইকেট নেওয়ার পরেও অমন ছুটকো উৎসবে সব মিটিয়ে ফেলতে পারতেন নাকি? দাঁড়ান, দাঁড়ান। শুধুই বা কোহলি-রোহিত বলি কেন? শুভমান গিল। ঋষভ পন্থ। এঁরাও ব্যাটার হিসেবে কম বলীয়ান নন। বৃহস্পতিবার চেন্নাই টেস্টের প্রথম দিন শেষে দুই রবি-রশ্মিতে (রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং রবীন্দ্র জাদেজা) ভারত প্রত্যাবর্তন করেছে বটে। কিন্তু এ দিন একটা সময় পর্যন্ত চিপকে রাজত্ব করে গিয়েছেন তিনি, বছর চব্বিশের পদ্মাপার পেসার হাসান মেহমুদ। এবং দিন শেষে তাঁর ১৮-৪-৫৮-৪ বোলিং পরিসংখ্যান দেখে আন্দাজ পাওয়া যাবে না, এ দিন একটা লম্বা সময় কী তেজিয়ান বোলিং করে গিয়েছেন তিনি। হাসানেরই দাপটে ভারত একটা সময় রোহিত-বিরাট-শুভমান-পন্থ সবাইকে হারিয়ে ১৪৪-৬ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু তার পরেও উর্ধ্ববাহু-উৎসবের আশপাশ দিয়েও যাননি হাসান। বাংলাদেশের নতুন ‘পেস সেনসেশন’-কে আঠারো-উনিশ বছর বয়স থেকে দেখেছেন যিনি, সেই প্রাক্তন বাংলাদেশ অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ফোনে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে বলছিলেন, ‘‘এখন তো তবু দেখি একটু-আধটু সেলিব্রেট করে। আগে তো তা-ও করত না। উইকেট নিয়ে নির্বিকার থাকত।’’ শুনলাম, ও পার বাংলার সাংবাদিকরা হাসানকে একবার সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নও করেছিলেন যে, কেন তিনি উইকেট নিয়ে বাকি পেসারদের মধ্যে উৎসব করেন না? জবাবে ওই অপূর্ব উত্তর দিয়েছিলেন হাসান। যা লিখেছি পূর্বে। ‘‘আরে, আউট হলে ব্যাটারের খারাপ লাগে তো!’’ শুনলাম, এ হেন ঋষি-সুলভ মনোভাব দেখে পদ্মাপারের সাংবাদিককুল তাঁর একটা নামও দিয়েছেন–নিভৃতচারী!
শুনলাম, হাসান শৈশব থেকেই এমন। স্বভাবগত ভাবে চুপচাপ। লাজুক। ঢাকার ছেলে নন হাসান। লক্ষ্মীপুরের। যা আদতে মফস্বল। বাংলাদেশ জাতীয় দলের শরিক হওয়ার পরেও তাঁর পুরনো স্বভাবের পরিবর্তন দেখেননি কেউ। হইহল্লায় থাকেন না। যৌবনের সহজাত উল্লম্ফনে বিশ্বাস করেন না। হাসানের পরিবারও একই রকম। গত বছর তাঁরা হাসানের বিয়ে দিয়ে দেন, ছেলের মহিলা অনুরাগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বলে! ফোনে বাশার বলছিলেন, ‘‘কিন্তু ছেলেটা স্মার্ট ক্রিকেটার। যা আপনি শেখাবেন, অতি দ্রুত শিখে ফেলবে। আজ রোহিত-বিরাটের উইকেট নেওয়ার পর হাসান নিয়ে অনেকেই স্তম্ভিত। কিন্তু আমি নই। দেখুন, এক স্থানীয় টুর্নামেন্টে ওকে প্রথম দেখি আমি। তখন কিন্তু বলে ভালো গতি ছিল হাসানের। ঘণ্টায় প্রায় একশো চল্লিশ কিলোমিটার প্লাস গতিতে বল করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চোট লেগে যায় হাসানের। তার পর গতিটা কমে একটু। কিন্তু সিমের ব্যবহার ওর সহজাত ছিল। তাতে এতটুকু মরচে পড়েনি। বল দু’দিকে মুভও করাতে পারে হাসান।’’ একটু দম নিয়ে প্রাক্তন পদ্মাপার অধিনায়ক ফের শুরু করেন, ‘‘শুরু থেকে আমি ওকে একটাই কথা বলতাম। বলতাম যে, ফিটনেস ধরে রাখতে। ফিটনেসের অভাবে অনেক অসামান্য প্রতিভাকে আমি অকালে ঝরে যেতে দেখেছি। ভালো লাগছে দেখে যে, হাসান সেই পরামর্শ শুনেছে। যা-ই বলুন, বাংলাদেশ কিন্তু ভালো একজন পেসার পেয়ে গেল।’’
নিঃসন্দেহে। চিপক টেস্ট বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত হারুক বা জিতুক, এটা লিখতে হবে নিশ্চিত ভাবে। রাওয়ালপিন্ডিতে দ্বিতীয় টেস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন হাসান। কিন্তু সেটা নিছক পরিচিত দিয়েছিল মাত্র। বৃহস্পতিবারের চিপক পদ্মাপারের প্রতিভাকে যোগ্য প্রতিষ্ঠা দিল। আসলে ভারত যে তাই করে। এই বিশ্বে আজও ভারতই যে কোনও প্রতিভার প্রথম ও প্রধান স্বীকৃতি-ভূমি!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.