বিশ্বদীপ দে: ১৯১৫ সালের ২৮ জুন। সিডনির আকাশ সেদিন ধূসর। হাড়হিম ঠান্ডায় কাঁপছে মানুষ। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁতেই এক শোকসংবাদে সেই শীত আরও তীব্র হয়ে চেপে বসল জনমানসে। সেই শোক কতটা তীব্র তা বোঝা গেল দুদিন পরে। সেদিন যেন গোটা সিডনি ভেঙে পড়ছিল শবযাত্রায়। কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই এভাবে চলে যাবেন কিডনির অসুখে ভেঙে পড়ে। তিনি ভিক্টর ট্রাম্পার। সদ্য বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়া সেই প্রাচীন পৃথিবীতে তিনিই ছিলেন সেরা ব্যাটার। পরবর্তী সময়ে সেই শিরোপা যিনি কেড়ে নেবেন, তিনি অর্থাৎ স্যার ডন ব্র্যাডম্যান তখন মাত্র বছর ছয়েকের শিশু!
আজকের পৃথিবী কতটা মনে রেখেছে ভিক্টর ট্রাম্পারকে? ১৮৯০ সালের কাউন্টি মরশুম থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত যে সময়কাল, সেটাই ‘ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ’ বলে ধরেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা। আর সেই যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান তিনি। যাঁর অভিষেক টেস্ট ছিল ডবলিউ জি গ্রেসের শেষ টেস্ট। সেই সিরিজেই জীবনের প্রথম টেস্ট শতরান করেন ট্রাম্পার। যা দেখে নিজের ব্যাটটি তাঁকে উপহার দেন ‘ক্রিকেটের পিতামহ’। লিখে দেন, ‘ফ্রম দ্য পাস্ট চ্যাম্পিয়ন টু দ্য ফিউচার চ্যাম্পিয়ন’। সিবি ফ্রাই, জ্যাক হবস বা উইলফ্রেড রোডসের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা মেনে নিয়েছেন ট্রাম্পারই ক্রিকেটীয় দক্ষতায় সেরা, ব্র্যাডম্যান নন! কিন্তু এর পরও আজ যেন বিস্মৃতপ্রায় ট্রাম্পার। সময়ের নিয়মই তাই। তার নিষ্ঠুর ব্রাশ সব মুছে দিতে চায়। আজকের প্রজন্মের কেউ যদি ট্রাম্পারের নাম শুনে গুগলে সার্চ করেন তিনি হয়তো নাক সিঁটকাবেন। ৪৮ টেস্ট। ৩ হাজার ১৬৩ রান। গড় ৩৯.০৪। শতরান ৮টি। অর্ধশতরান ১৩টি। সর্বোচ্চ ২১৪ অপরাজিত। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গড় সামান্য বেশি। ৪৪.৫৭। এই পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই মন্দ নয়। কিন্তু ‘গ্রেট’-এর নিক্তিতে মাপতে গেলে মুশকিল।
আর এখানেই গোলমাল। নেভিল কার্ডাসের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেট লিখিয়ে লিখেছিলেন, ‘স্কোরবোর্ড একটা গাধা। কেননা তা এক সুন্দর গাথাকে ধ্বংস করে দেয়।’ ট্রাম্পারের বিষয়টিও তাই। কেবল স্কোরের নিরিখে তাঁকে মাপা যাবে না। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের জলছাপ বহন করে চলেছে কিছু রূপকথা। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপকথা আর্থার মেইলির। অসাধারণ লেগস্পিনার। গুগলিও করতেন একেবারে নিখুঁত। খেলতেন অস্ট্রেলিয়ার হয়েই। ঘরোয়া ক্রিকেটে একবার তিনি আউট করে দিলেন ট্রাম্পারকে! তার আগে ট্রাম্পার তাঁকে এবং বাকি বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই অবস্থায় মেইলির তো উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া। কিন্তু হল উলটো। তাঁর মনখারাপ হয়ে গেল। পরে তিনি সেই মুহূর্তটার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ”এই উইকেটটা নেওয়ার মধ্যে উৎসবের কোনও রেশ ছিল না। বরং আমার নিজেকে সেই বালক মনে হচ্ছিল, যে এক্ষুনি একটা পাখিকে মেরে ফেলেছে!”
আর এক কিংবদন্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নিউ সাউথ ওয়েলসের রেগি ডাফ। একসঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি ও ট্রাম্পার। দুজনই ওপেন করতেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে রেগি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কিন্তু শেষকৃত্যের খরচ উঠছিল না। রেগি টেস্ট ক্রিকেটার হলেও সেযুগে ক্রিকেট মোটেই অর্থকরী ছিল না। দেখা যায়, যত অর্থ প্রয়োজন উঠেছে তার অর্ধেক। বাকি অর্ধেকটা একাই দিয়ে দিলেন ট্রাম্পার। নিজে থাকলেন শেষকৃত্যের পুরোটা সময়। তার পর ফিরে এসে যোগ দিলেন অ্যাসেজের সিডনি টেস্টে। যেদিন সমাধিস্থ হলেন রেগি, সেদিন থেকেই শুরু টেস্ট। বন্ধুর মৃত্যুশোক মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নেমেও ট্রাম্প করে গেলেন দুরন্ত শতরান। যদিও প্রথম রান করতে নেন মিনিট পঁচিশেক। মাঠে উপস্থিত ১৭ হাজার দর্শক সেই মুহূর্তে ব্যঙ্গই করেন ট্রাম্পারকে। তা দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। তার পর শুরু হল মার-মার। ১১৩ করে কভারে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন ট্রাম্পার। ততক্ষণে অবশ্য রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন। অ্যাসেজে সর্বোচ্চ ৬টি শতরান (সেসময় এটাই রেকর্ড ছিল)। শুধু তাই নয়, গোটা সিরিজে ওই একটাই শতরান দুদলের খেলোয়াড়দের মধ্যে। আর একটা কারণে ওই সেঞ্চুরি স্মরণীয়। ওটাই ছিল ট্রাম্পারের শেষ টেস্ট শতরান।
ট্রাম্পারের আর এক কীর্তি লাঞ্চের আগেই শতরান। সেই প্রথম এই কৃতিত্ব কেউ অর্জন করল। সেটা ১৯০২ সাল। ম্যাঞ্চেস্টারে সিরিজের চতুর্থ টেস্টের প্রথম দিনের খেলায় লাঞ্চের আগেই তিন অঙ্কে পৌঁছে যান ট্রাম্পার। করে যান ১০৪। মেরে ছিলেন ১৪টি বাউন্ডারি। লাঞ্চে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে যায় ১ উইকেট খুইয়ে ১৭৩ রানে। পরবর্তী ডন ব্র্যাডম্যান-সহ অনেক ব্যাটসম্যানই এই নজির স্পর্শ করেছেন। কিন্তু প্রথমবারের জন্য কীর্তিটি লেখা হয়ে যায় ট্রাম্পারের নামে।
সিডনি ক্রিকেট মাঠের পাশেই ছিল মুর পার্ক। সেখানে একটা পুকুর ছিল। সেই পুকুরের নাম লোকের মুখে মুখে হয়ে যায় লেক ট্রাম্পার। কেননা মাঠে দাঁড়িয়ে এমন বিশাল সব ছক্কা নাকি মারতেন ট্রাম্পার সাহেব যে বল এসে পড়ত মাঠের পাশের পার্কের পুকুরে! আরেক কিংবদন্তি সিডনির রেডফার্ন ওভালে। ১৯০৩ সালে সেই মাঠে একটি ছক্কা মারেন ট্রাম্প। বল সোজা গিয়ে মাঠের পাশের রাস্তা পেরিয়ে একটি জুতো কারখানার দ্বিতীয় তলার জানলার কাচ ভেঙে দেয়! তাঁকে সম্মান জানাতে ওই কাচটি অমনই রেখে দেওয়া হয়। পরবর্তী ৬০ বছর ভাঙা কাচের জানলাটি ছিল সেখানকার এক দ্রষ্টব্য স্থান। লোকে আঙুল দেখিয়ে বলত, ”ওই যে ট্রাম্পারের সেই ছক্কা এখানেই পড়েছিল!” শুনতে শুনতে মনে হয়, এমন মেজাজের খেলোয়াড় আজকের টি২০-তেও সমানে সোনালি ফসল ফলাতেন।
যাই হোক, অসংখ্য ক্রিকেট গাথায় এভাবেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে রয়ে গিয়েছেন ট্রাম্পার। আর মিথকে স্পর্শ করার ক্ষমতা স্কোরবোর্ডের কোনওদিনই নেই। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে, ট্রাম্পারকে খেলতে হত ‘স্টিকি উইকেটে’। সেযুগে উইকেট ঢাকা থাকত না। বৃষ্টিতে তা ভিজে যেত অনর্গল। পরে রোদ উঠলে প্রায় পাঁকালো একটা অবস্থা হত (যাকে বলা হত ‘স্টিকি ডগ’)। সেই পিচেই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে অসুবিধে হয়নি ট্রাম্পারের। তাঁর ফুটওয়ার্ক ছিল নিখুঁত। কবজি অসম্ভব শক্তিশালী। গুড লেংথ বলকে গুঁড়ি মেরে দ্রুত এগিয়ে ড্রাইভ করতে পারতেন। কিন্তু সবচেয়ে ভালো মারতেন লেগ গ্লান্স। অফস্টাম্পের বাইরে প্রচণ্ড জোরে ধেয়ে আসা বলকে সপাটে পুল করে স্কোয়ার লেগ দিয়ে সীমানা পার করে দিতে জানতেন। সামনের প্যাডে আছড়ে পড়তে চলা বলে একটি অসামান্য স্ট্রোক খেলতেন ট্রাম্পার। যার নামই ছিল ডগ শট। পরবর্তী সময়ে অনেকে সেই মার নকল করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক্রিকেটের প্রথম রাজার মতো দক্ষতা কারওই দেখা যায়নি। জানা যায়, শতরান করার পর অনেক সময়ই উইকেটটা বোলারকে দিয়ে যেতেন ট্রাম্পার। আসলে অনেকক্ষণ খেলার পর তাঁর মনে হত এবার বিপক্ষকেও একটা সুযোগ দেওয়া উচিত!
আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু সেই সময়টাই ছিল এমন। ক্রিকেটের রোম্যান্টিক যুগ শেষ হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাপটে। ক্রিকেটের শিল্পায়ন ঘটে যায় তখন থেকেই। মাত্র দেড় দশকের মধ্যেই ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করতে এসে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, যতক্ষণ পারবেন ততক্ষণ থাকবেন। ৯৯.৯৪ গড়ে মাত্র ৫২ টেস্টের ২৯ শতরানে সর্বকালের সেরা হয়ে ওঠার পিছনে ছিল এই ‘নিষ্ঠুর’ পেশাদারিত্ব।
তবুও ট্রাম্পার থেকে গিয়েছেন। খোদ কার্ডাস সাহেব, যাঁর কলমে ক্রিকেট হয়ে উঠত সাহিত্য, তিনি ব্র্যাডম্যান ও ট্রাম্পার দুজনের খেলাই দেখেছিলেন। আর তা নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, ”আমার কাছে ট্রাম্পার একজন শিল্পী। ম্যাচ জেতানো স্কোরার নন। ট্রাম্পারের ব্যাটসম্যানশিপের পরিচয় পেতে হলে আপনি যদি কেবল রান গুনতে থাকেন কিছুই পাবেন না। ঠিক যেমন শেলির কবিতার গুণ বিচার করতে বসে কেউ যদি কেবলই তাঁর কবিতার পঙক্তি গোনেন।”
কেবলই স্টাইল, কেবলই চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি নয়, ট্রাম্পারের খ্যাতির নেপথ্যে ছিল তাঁর দয়ালু মনও। এক কাগজ বিক্রেতা কিশোর বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে দেখে তার সব ভেজা কাগজ অবলীলায় কিনে ফেলেছিলেন তিনি। জুনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যাট, বল কিনে দিতেন আকছাড়। তাই আমজনতার কাছে তাঁর একটা অন্যরকম আবেদন ছিল। এমন মানুষের শবযাত্রাতেই তো হাজার হাজার মানুষের নীরব ভিড় থাকার কথা। শেষ করা যাক কার্ডাস সাহেবের কলমে সেই বিষণ্ণ দিনটির কথা দিয়ে- ‘উনি হয়তো অমরতার শীতল কক্ষ থেকে উঁকি দিয়ে দেখবেন… এবং কাঁদবেন, আরও একটা সূর্য ও বাতাসের দিন। অথচ আমি ওখানে নেই। ওখানে নেই।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.