বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, ময়নাগুড়ি: “দিনকাল ভাল ঠেকছে না গো কর্তা। কেন যে আইলেন!”নৌকার মাথায় বসে নিচু গলায় বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব মাঝি নিবারণ সরকার। পরনে লুঙ্গি, খালি গা। গামছা দিয়ে
নাকমুখ ঢেকে রেখেছেন। লকডাউনের পর এই প্রথম নৌকা নিয়ে নদীর এ পারে এলেন। ঘাটে নৌকা এনে মাটিতে পা রাখেননি। উঠে বসতে হ্যাঁচকা টানে জলে ভাসলেন।
ভরা চৈত্র। পাহাড়-সমতলের আকাশ ঝকঝকে নীল। তিস্তায় তেমন জল নেই। তবে কিছু জায়গায় গভীরতা বেশ স্পষ্ট। সেখানে পাক খেয়ে ঘোলা জল আছড়ে পড়ছে চরের গায়ে। খসে পড়ছে বালি-মাটির চাঙর। মাঝ নদীতে ঢেউয়ের মাথায় দুলতে থাকা নৌকায় মাঝির পাশে বসে গুনগুন করে গান ধরেছেন মলিন দাস, তিস্তার বুকে জেগে থাকা মতিয়ার চরের যুবক। বয়স চল্লিশ ছুঁয়েছে। গায়ের গেঞ্জি ঘামে ভিজে একসা। অনেক কষ্টে ওঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে লকডাউনে নদীঘেরা দ্বীপের জনজীবন দেখার সুযোগ করে নেওয়া হল। তিনিই প্রবীণ মাঝি নিবারণবাবুকে বলেকয়ে এনেছেন পারাপারের জন্য।
অবিন্যস্ত মাথার চুলে হাত বুলিয়ে নিবারণবাবুর দিকে তাকান মলিন। বলেন, “কী খারাপ গো কর্তা!” নিবারণবাবুও সবিস্ময়ে তাকান। জানতে চান, “করোনার নাম শুনস নাই!” মলিন হাসেন। বলেন,
“পৃথিবীর অসুখ গো কর্তা, পৃথিবীর অসুখ।” কত মানুষ মারা গেছে জানেন ? প্রশ্ন করতে নিবারণবাবু নদীর ওপারে বাঁধের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যান। বলেন, “জানি না। জানব কেমনে? আমরা তো শহরে থাকি না। শুনছি রোগটা শহরের। রোগের কথা শুনতেই এখানে পারাপার বন্ধ।”
কার্যত সেই থেকে তিস্তা নদীঘেরা সবুজ দ্বীপের মতো ময়নাগুড়ি ব্লকের অধীন দুর্গম মতিয়ার চর, পদমতির চর, লক্ষ্মীর চর, ফাটার বাড়ি, সদর ব্লকের বাহির চর, কালামপুর চর, কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের নিজতরফ চর এলাকা নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করেছে। অন্তত ১৫ হাজার মানুষের বসবাস এখানে। শুধুমাত্র মতিয়ার চরেই ভোটদাতার সংখ্যা প্রায় তিনশো। কালামপুরে রয়েছেন প্রায় চারশো বাসিন্দা। নদীবাঁধ থেকে এলাকাগুলোর দূরত্ব গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার। পরিবহণ বলতে নৌকা। ওপারে নেমে আরও অন্তত তিন কিলোমিটার নলখাগড়ার জঙ্গল ভেঙে বাঁশ বাগান ঘেরা জনপদ, চাষের মাঠ। সেখানে করোনা নিয়ে ভয়ডর নেই যেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.