ছবি: প্রতীকী
দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: ঝড়ে ভেঙে পড়েছে দেওয়াল। কিন্তু, বুকে করে চারপেয়েদের আগলেছেন সুচিত্রা। গ্রামের নাম জ্যোতিরামপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গাড়াল নদী। চার ছাগল নিয়ে সে নদীর পাড়ে সংসার সুচিত্রা দেবীর। আয়লা ছিনিয়ে নিয়েছে স্বামীকে। সে ক্ষত এখনও টাটকা। বছর পঞ্চাশের মহিলা বলেন, ‘একমাত্র ছেলে বেঙ্গালুরুতে কাজ করে। মেয়ে থাকে মামার বাড়িতে। এই চার ছাগল নিয়েই আমার দিন কাটে।’ নদীর পাড়ে জঙ্গলের বাইন, ক্যাওড়া ও গরানের পাতা খাইয়ে ছোট থেকে বড় করেছেন ছাগলগুলোকে।
ঝড়ের খবর পেয়ে একেবারে ঘরের কোণে সিঁটিয়ে আছেন শুক্রবার থেকে। শনিবার সারারাত বুলবুলের প্রকোপে কেঁপে কেঁপে উঠেছে ঘরের চাল। আতঙ্কে চার ছাগল নিয়ে বসে ছিলেন খাটের তলায়। চোখের সামনে একের পর এক বাড়ি খড়কুটোর মতো ভাঙতে দেখেছেন। দেওয়াল পড়ে আহত হয়েছেন নিজেও। কিন্তু, সন্তানের মতো আগলেছেন ছাগলগুলোকে। নদীর ধারে দিন কাটে চারপেয়েদের সঙ্গেই। তাদের বিভিন্ন নামে ডাকলেই সাড়া দিতে থাকে লেজ নেড়ে, কান উঁচু করে। ঝড়ের দাপটে ছাগলগুলোকে বাঁচিয়ে নিজেই আজ আহত। ২০০৯ সালের ২৫ মে। সেবার যখন আয়লা আঘাত হেনেছিল। জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন স্বামী। কয়েকদিন পর এলাকার ধানখেত থেকে উদ্ধার হয়েছিল স্বামীর পচাগলা দেহ। সেই যন্ত্রণা নতুন করে তাড়া করে বেড়াল শনিবারের বারবেলায়। সকালে যখন প্রশাসনের আধিকারিকরা ওই এলাকায় যান দেখেন সুচিত্রাদেবীর গায়ে ভেঙে পড়েছে দেওয়াল। তাঁকে উদ্ধার করে পাঠানো হয় এলাকার একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন তিনি।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুচিত্রাদেবী বিড়বিড় করছেন, ‘ওরা কেমন আছে…?’ একটু সুস্থ হতে জানিয়েছেন, ‘আমার সম্বল বলতে ওই চারটি ছাগলই। বিক্রি করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আসতে পারে। যদি ঝড়ে চারটি ছাগল মরে যায় তাহলে মেয়ের বিয়ে দিতে পারব না। অনেক কষ্ট করে ছাগলগুলোকে বড় করেছি। তাই ঝড়ের রাতে সারারাত বুকের মধ্যে আগলে ধরে রেখেছিলাম ছাগল চারটি।’
তবে শুধু সুচিত্রাদেবী নন, সুন্দরবনের বহু মানুষ কাজের জন্য থাকেন ভিন রাজ্যে। সরকার থেকে পাওয়া গৃহপালিত এইসব প্রাণীগুলি মূলত এলাকার মানুষের আয়ের একমাত্র রাস্তা। সুচিত্রাদেবীর মতো রাজবালা সরদার, ভানুমতী দাস ও কল্যাণী মণ্ডল একইভাবে জীবিকা অর্জন করেন ছাগল পালন করে। আগে সুন্দরবনের জঙ্গলে কাঁকড়া সংগ্রহ করতে গেলেও এখন আর যান না। এই ছাগলগুলো বড় করে বিক্রি করেই মূলত জীবিকা অর্জন করেন। ঝড়ের ফলে এই সমস্ত গৃহপালিত পশুগুলোরই বেশি ক্ষতি হয়। গরু-ছাগল-সহ অন্যান্য প্রাণী এলাকার অর্থনৈতিক এবং রোজগারের একমাত্র রাস্তা। আর তাই নিজের জীবন বাজি রেখে ঝড়ের রাতে ছাগল বাঁচানোর একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করেছিলেন সুন্দরবনের এই রমণী।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.