ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ আর কাশ ফুলের মহড়া৷ বাতাসে এ কীসের গন্ধ! ঢাংকুনাকুর ঢাকের তালে সূচনা হয়ে গিয়েছে দেবীপক্ষের৷
এবার দল বেঁধে ঘর ছাড়ার পালা ওঁদের৷ ওঁরা ঢাকী৷ গ্রাম ছেড়ে দল বেঁধে পুজো মণ্ডপে ঢাক বাজাতে যাওয়া পুরনো দস্তুর৷ সারা বছর চাষের কাজ৷ আর বছরের এই সময়টা একটু পয়সার আশায় শহরে আসা৷ কিন্তু এ তো কয়েক যুগ ধরে চলে আসা আম ঢাকিদের গপ্পো৷ কিন্তু ওঁরা? ওঁদের গল্পটা একটু আলাদা৷ পুজোয় অন্য মায়েরা যখন দেবীবরণে ব্যস্ত হবেন৷ তখন ওঁরা বেরিয়ে পড়বেন দূর দুরান্তে৷ ছেলেদের মতোই ঢাক কাঁধে৷ কেউ বেরোবেন সংসারের তাগিদে কেউ বা আবার শখ করে৷ কেউ আবার পরিবারের ট্রাডিশান বজায় রাখতে৷ ওঁরা মহিলা ঢাকির দল৷
উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুর বিধানপল্লির প্রমীলা, মৌমিতা, সংগীতা, উমা, জ্যোৎস্নাদের এখন প্রস্তুতি তুঙ্গে৷ গ্রামের অভিজ্ঞ ঢাকি গোকুলচন্দ্র দাসের কাছে তালিম নিয়ে এখন দেশ-বিদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা৷ গত কয়েক বছর ধরে পুরুষ ঢাকিদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পুজোর চিরাচরিত বাদ্যি বাজিয়ে মণ্ডপ মাতিয়ে তুলছেন পাড়াগাঁয়ের এই মেয়েরা৷ কেউ গৃহিণী, কেউ ছাত্রী, তবে তার থেকেও বড় পরিচয় তাঁরা ঢাকি৷
২০১০ সালে গ্রামের পাঁচজন মেয়েকে নিয়ে ঢাকের তালিম দেওয়া শুরু করেন গোকুলবাবু৷ বর্তমানে তাঁর দলে মহিলা ঢাকির সংখ্যা ২৮ জন৷ বিধানপল্লিতে গোকুলবাবুর বাড়িতেই নিয়মিতভাবে অনুশীলন করেন তাঁরা৷ এখন তাঁদের নেশা ও পেশা দুটোই ঢাক৷ গোকুলবাবুর দলে ১৫০ জন পুরুষ ঢাকিও রয়েছে৷ তবে তাঁদের থেকে কোনও অংশে কম নন প্রমীলা, মৌমিতার মতো মহিলা ঢাকিরা৷
বিলেতে গিয়ে এক মহিলা মিউজিশিয়ানকে দেখে মহিলা ঢাকির দল তৈরি করার কথা মাথায় আসে গোকূলবাবুর৷ মহিলা ঢাকির দলের এক সদস্য প্রমীলা দাসের স্বামীও পেশায় ঢাকি৷ গোকুলবাবুর হাত ধরে তিনিও এই পেশায় এসেছেন৷ প্রমীলাদেবী বলেন, “প্রথমে শখে ঢাক শেখা শুরু করি৷” এই দলেরই আরেক ছোট্ট সদস্য মৌমিতা কলেজ ছাত্রী৷ পড়াশোনা করতে করতে ঢাক বাজানোকে সে জীবন ও জীবিকা করে নিয়েছে৷
তবে এই অনেকেই এই পেশায় এসেছেন পেটের তাড়নায়৷ অভাবের সংসারের হাল ধরতেই হাতে তুলে নিয়েছেন ঢাকের কাঠি৷ দলের সদস্যদের থেকে জানা জানা যায়, প্রতিটি অনুষ্ঠানে পারিশ্রমিক হিসাবে তাঁরা পাঁচশো টাকা পান৷ বছরে মোট পঞ্চাশ থেকে ষাট দিন অনুষ্ঠান পান তারা৷ সারা বছর কোনও মতে কেটে যায়৷ তাই এই পুজোর দিকেই মুখিয়ে বসে থাকেন সবাই৷
গোকুলবাবু বলেন, “সরকারের থেকে লোকশিল্পীদের ভাতা দিচ্ছে৷ তবে তা সকলে পায় না৷ অধিকাংশ ঢাকিদেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ৷” তবে চরম অর্থসঙ্কট থাকলেও ঢাকের বোলে কিন্তু তা ফুটে ওঠে না৷ কলকাতা থেকে টাকী, হাওড়া থেকে বেলঘরিয়া৷ শহরের নামকরা সব পুজো মণ্ডপে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে ঢাক কাঁধে পুজোর আমেজ তৈরি করবেন তাঁরা৷ শুধু এ রাজ্যে নয়, এমনকী রাজধানী দিল্লিতেও পুজো মাতাবেন মছলন্দপুরের এই মহিলা ঢাকিরা৷ গ্রামবাংলার এই মায়েদের ঢাকেই বরণ হবে ‘মা’ জগজ্জননীর৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.