ছবি: প্রতীকী
সৈকত মাইতি, তমলুক: অভাব অনটনের মাঝে একঘেয়েমি সংসারী জীবন। তবুও সেই জীবনের একটু আনন্দ খুঁজে নিতে স্বামী ও কোলের সন্তানকে নিয়ে নিজের পুরানো জন্মভিটেতে বেড়াতে গিয়েছিলেন তমলুকের এক গৃহবধূ। সেই বাপের বাড়ি থেকে বাইক চড়ে বাড়ি ফেরার পথে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় স্বামী- সন্তান সহ সপরিবারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন গৃহবধূ। বুধবার ১১৬ বি জাতীয় সড়কে কোলাঘাটের উপনগরী এফ টাইপ মোড় এলাকার মর্মান্তিক এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়ায়। শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা গ্রাম জুড়ে। সবকিছু হারিয়ে, একেবারে সহায় সম্বলহীন, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা।
তমলুকের (Tamluk) শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের বল্লুক ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত হোগলবেড়িয়া গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা সুদীপ কালশা (২২)। বছর তিনেক আগে বাবা পেশায় ভ্যানচালক তপন কালশার মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই জীবনে নেমে আসে একের পর এক দুর্যোগ। বাবার মৃত্যুর পর মা বেহুলা কালশা পুনরায় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। গ্রামের এক চিলতে টালির মাটির বাড়িতে তাই অসহায় বৃদ্ধা ঠাকুমা সুশীলা কালশাকে নিয়ে কোন রকমে বসবাস। জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে কখনো দিনমজুরি করে আবার কখনো গ্রামের হাটে সবজি ফেরি করে সংসার চলছিল। সংসারের হাল ফেরাতে বৃদ্ধ ঠাকুমাও আশপাশের একটি হোসিয়ারি কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। এমন অবস্থায় এই ঠাকুরমার পরামর্শেই দেখাশোনা করে পশ্চিম মেদিনীপুরের বালিচকের কানুরামের বাসিন্দা পূজার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বছর দুয়েক আগে জন্ম নেয় মেয়ে পায়েল।
স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে নিজের বাপ ঠাকুরদার পুরনো জন্মভিটে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার শখ হয়েছিল পূজার। তাই পরিকল্পনা মত দিন পাঁচেক আগে মায়ের কাছ থেকে উপহারের পাওয়া পুরনো একটি বাইকে চড়ে সপরিবারে বালিচকে পৌঁছায় সুদীপ। এরপর সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে সপরিবারে উড়িষ্যায় যায়। সেখান থেকে সপরিবারে ফের ট্রেনে চড়ে বালিচকে বাপের বাড়িতে পৌঁছায় পূজা। এরপর এদিন সকাল সাতটা নাগাদ ফের উপহারে পাওয়া পুরনো বাইকটি চড়ে তারা তমলুকে গ্রামের বাড়ি ফিরছিল। পথে সকাল ১১ টা নাগাদ মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বাইকের পেছনে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয় একটি দীঘা গামী যাত্রীবাহী সরকারি বাস। মুহূর্তেই বাইক থেকে ছিটকে পড়ে গুরুতর জখম হন তিনজন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে মেচেদার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা পূজাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকিৎসা চলাকালীন মৃত্যু হয় সুদীপ ও তার একমাত্র মেয়ে পায়েলের। স্বাভাবিক কারণেই এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। সকলকে হারিয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বৃদ্ধা, সুশীলা দেবী। কান্নায় ভেঙে পড়েন পূজার বাপের বাড়ির আত্মীয় পরিজনেরাও। তাম্রলিপ্ত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে দেহ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে পূজার বাবা রবি দাস বলেন, “কোন রকমে গান বাজনা ভিক্ষা করে সংসার চলে আমাদের। তার মধ্যেই একমাত্র মেয়ে পূজার দেখাশোনা করে বিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু চোখের সামনেই নিয়তির করুন পরিহাসে যেন দুঃস্বপ্নের মত সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আদরের একমাত্র নাতনিকেও আমরা ফিরে পেলাম না।” বল্লুক ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বিশ্বজিৎ ঘোড়া বলেন, “হাসিখুশি মিশুকে স্বভাবের সুদীপ ছেলেটি নানা টানপোড়েনের পরেও নিজের প্রচেষ্টায় একটু একটু করে সংসারের হাল ফেরানোর চেষ্টা করছিল। মাস ছয়েক আগেই মায়ের কাছ থেকে পুরনো একটি বাইক উপহার পেয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেই যে কিভাবে এমন ঘটনা ঘটে গেল তা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে ওদের অন্তেষ্টিক্রিয়া সহ অন্যান্য কাজকর্মের জন্য আমরা যাবতীয় তৎপরতা শুরু করেছি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.