সুনীপা চক্রবর্তী: রাজ্যে ঢুকে পড়েছে কনকনে শীতল হাওয়া৷
ভোরের দিকে তো বটেই, রাতেও তার উপস্থিতি ভালই জানান দিচ্ছে শীত৷ আর শীত মানেই গরম জামাকাপড়, চাদরের নিচে নিজেকে জড়িয়ে রাখার পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে রসনাতৃপ্তির বিষয়টি৷ শীতকালে নতুন নতুন সবজি বাজারে ওঠে৷ তেমনই যাঁরা মিষ্টি ভালবাসেন, তাঁরাও মুখিয়ে থাকেন শীতকালের জন্য৷ কারণ একটাই৷ শীতকালেই মেলে খেজুর গুড়, পাটালি এবং অবশ্যই নতুন গুড়ের সন্দেশ, রসগোল্লা৷ জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রামে খেজুর গাছগুলিতে এখন তাই সার দিয়ে কলসি বাঁধা রয়েছে৷ সারারাত ধরে কলসিতে টুপ-টুপ করে পড়ছে খেজুরের টাটকা রস৷ এই রস জাল দিয়েই তৈরি হয় গুড়৷ আর যাঁরা এই গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের ব্যস্ততা চরমে ওঠে শীত শুরুর এই সময়টায়৷
ঝাড়গ্রাম থেকে বাইপাস পিচ রাস্তা ধরে জামবনির দিকে এগোলে রাস্তার ধারে ফাঁকা মাঠে ঝুপরি করে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে রয়েছেন খেজুর গুড় তৈরির এই কারিগররা৷ খেজুর গাছের পাতা দিয়ে অনবদ্য হাতের কাজের মাধ্যমে গড়ে তোলা ছোট ঘরগুলি যেন নিজেই একটা শিল্প৷ এক ঝলকে দেখলে মনে হবে অনেকটা ‘ইগলুর’ মতো৷ আর এই ছোট্ট ঘরে বিজলি বাতি ছাড়াই টিম টিমে খুপির আলোয় ওদের বাস৷ সারা দিন ঘুরে ঘুরে ২০-২৫টি খেজুর গাছ কেটে রসের জন্য মাটির হাঁড়ি টাঙিয়ে আসেন৷ কাকভোরে উঠে কনকনে হাড়হিম করা ঠান্ডায় আর শীতে ওরা নাম কা ওয়াস্তে গায়ে হয়তো চাপান পাতলা জামা নয়তো আবার খালি গায়েই বেরিয়ে পড়েন রস সংগ্রহের জন্য৷ রস সংগ্রহ করে সারাদিন ধরে চলে জাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ৷ অবশ্য তার আগে খুব ভোরে রসের হাঁড়ি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চলে ‘রস নেবেন গো’ বলে হাঁকডাক৷ সকাল সকাল হাঁকডাকে জেগে ওঠেন পাড়ার লোকজন৷
শুধু ঝাড়গ্রামই নয় বেলপাহাড়ি, লালগড়, জামবনিসহ জঙ্গলমহলের বিভিন্ন্ গ্রামে শীতের শুরুতে এটাই চেনা ছবি৷ বাইপাসের ধারে শীতের দুপুরে ছোট্ট অস্থায়ী ঘরের সামনে গুড়ে জাল দিতে ব্যস্ত আসমান খান৷ তার সামনে বসে সহযোগী লাহার শেখ সদ্য ফোটানো সাদা ভাত শুধুমাত্র নুন দিয়ে খাচ্ছিলেন৷ সাংবাদিক দেখে খাবার ছেড়েই উঠে এলেন খরিদ্দার ভেবে৷ পরে বুঝতে পেরে হেসে বললেন, “আসলে খরিদ্দার আমাদের কাছে লক্ষ্মী৷ তাই সবার আগে তাঁরা৷”
নদিয়ার নবগ্রামের বাসিন্দা আসমান শেখ ও লাহার শেখের বর্তমান ঠিকানা রাস্তার ধারে অস্থায়ী ঝুপড়ি৷ পরিবার ছেড়ে রাতদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন৷ তরল গুড় আশি টাকা আর পাটালি একশো টাকা কেজি৷ দরদাম করলে অবশ্য কিছুটা কমবে৷ আগামী দু’তিন মাসে কমপক্ষে ৪৫-৫০ হাজার টাকা রোজগার করতে না পারলে ঘরে ফেরা যাবে না৷ আসমান শেখ বলেন,“দেশ অর্থাৎ গ্রাম ছেড়ে তিন-চার মাস শীতের মধ্যে কষ্ট করে পড়ে রয়েছি৷ কিছু রোজগার না করলে বছরের বাকি সময়টা খাব কী? তাই নুনভাত খেয়েও পড়ে থাকি এখানে৷” আর তাই শীতের কাঁপুনিকে অগ্রাহ্য করে সকলকে রসনার আস্বাদন দিয়ে চলেছেন আসমান শেখ, লাহার শেখরা৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.