জ্যোতি চক্রবর্তী, বনগাঁ: মতুয়া উদ্বাস্তুদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে অবশেষে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকর করার বিষয় বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কেন্দ্র সরকার। বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকেই উচ্ছ্বসিত বিজেপি প্রভাবিত মতুয়ারা। ডাংকা কাশি নিশান নিয়ে দলে-দলে মতুয়া ভক্তরা গাইঘাটা ঠাকুরনগর মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে ভিড় করছেন। সেখানে তাঁরা মেতেছেন আনন্দ উৎসবে। ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরকে। যদিও তৃণমূল পন্থী মতুয়াদের মধ্যে সেই উচ্ছ্বাস অবশ্য নেই। বংর চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। তাঁদের বক্তব্য, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড সবই আছে। তাহলে তাঁরা নতুন করে কেন আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নিতে যাবেন? ভালো-খারাপ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নাগরিকত্ব আইন যে লোকসভা ভোটে তুরুপের তাস হতে চলেছে, তা একবাক্যে স্বীকার করছেন অনেকেই। তবে বিজেপি না তৃণমূল কে লাভবান হবে বেশি, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না।
বনগাঁ লোকসভা আসনে মতুয়া ভোটার সংখ্যা কত তা নিয়ে মতুয়া মহলেই পরিষ্কার চিত্র নেই। শান্তনুবাবুর দাবি, প্রায় ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ মতুয়া ভোটার রয়েছে। মমতাবালা ঠাকুরের দাবি, ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মতুয়া ভোটার আছে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, বনগাঁ লোকসভা আসনে মতুয়া ভোটার সংখ্যা ৩০ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ হোক, কিন্তু এই আসনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে মতুয়ারা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। CAA কার্যকর করে মাস্টার স্ট্রোক দিতে চেয়েছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু নয়া আইন নিয়ে মতুয়ারা এখনও দ্বিধা বিভক্ত। যাদের ভোটার-আধার-প্যান কার্ড আছে তাঁরা আবেদন করবেন কিনা তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
তবে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত যারা এদেশে এসেছেন, যাদের ভোটার-আধার এখনও হয়নি তাঁরা এই সিদ্ধান্তে খুশি। যদিও এখনই তাঁদের ভোটার তালিকায় নাম ওঠানোর সম্ভাবনা নেই। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় উঠবে। ফলে এবারে লোকসভা ভোটে ওই সব মানুষের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা নেই | শান্তনুবাবু বলেন, “রাজ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করে। তার মধ্যে দেড় কোটি মানুষ ভোটার। ৫০ লক্ষের ভোটার-আধার কার্ড নেই। যারা ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এদেশে এসেছেন, যাদের ভোটার-আধার কার্ড আছে, তাঁদের আবেদন না করলেও চলবে।”
যদিও মতুয়াদের একটা বড় অংশ মনে করছে, তারা এদেশের নাগরিক হলেও পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে রাজ্য পুলিশের ডিআইবির পক্ষ থেকে ৭১ সালের আগের জমির দলিল চাওয়া হয়। নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। নাগরিকত্ব থাকলে এই হেনস্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন, বাংলার প্রায় তিন কোটি মতুয়ার মধ্যে অনেকেরই এখনও ভোটার-আধার কার্ড নেই। সিএএ-র মাধ্যমে তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন। স্বাভাবিকভাবে লোকসভা ভোটে তাঁদের সমর্থন বিজেপির দিকেই থাকবে। তবে তা ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ নেই।
১৯৪৮ সালে শান্তনু ঠাকুরের ঠাকুর দাদা প্রয়াত প্রমথরঞ্জন ঠাকুর বাংলাদেশ থেকে এসে ঠাকুরনগরে বসতি তৈরি করেন। ঠাকুরনগর জনপদের সৃষ্টি করেন। সেখানেই তৈরি হয় মতুয়াদের পিঠস্থান। রয়েছে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির কামনা সাগর। ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু মতুয়া নমঃশূদ্র শরণার্থীদের এদেশের স্থায়ী নাগরিকত্বের দাবিতে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীকালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের স্ত্রী বীণাপানি ঠাকুর একই দাবিতে আন্দোলন করেছেন ।পরবর্তী সময়ে শান্তনু ঠাকুররা সেই আন্দোলন জারি রেখেছিলেন।
সিএএ কার্যকর হওয়ার পর শান্তনু ঠাকুর বলেন, “আমাদের তিন প্রজন্মের আন্দোলনের জয় হল। এবার মতুয়া উদ্বাস্তুরা এদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে বাস করতে পারবেন।” বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদার বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রমে সিএএ কার্যকর হল। এতদিন মতুয়ারা বিজেপির দিকেই ছিলেন। সিএএ কার্যকর হওয়ার পর আরও বেশি সংখ্যক মতুয়া বিজেপির দিকেই চলে আসবে।”
যদিও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতা ঠাকুর। তিনি বলেন, “বিজেপি আবেদনের ভিত্তিতে কেন নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলছে? আবেদন করা মানেই তো চিহ্নিত হয়ে যাওয়া যে আমি নাগরিক নই, আমি নাগরিক হতে চাই। তখন বিজেপি এদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আর বেশিরভাগ মতুয়াই ভোটার-আধার কার্ড আছে এবং তাঁরা ভোট দেয় এদেশের নাগরিক।” তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “সিএএ নিয়ে বিজেপি রাজনীতি করছে। বিজেপি মতুয়াদের অধিকার হরণ করে নিতে চাইছে। যদি সদিচ্ছা থাকত, তাহলে তারা এতদিন কেন করল না? ভোটের আগে মতুয়াদের ভাঁওতা দিতে তাঁরা আবার আসরে নেমে পড়েছে।”
রাজনৈতিক মহলের মতে, CAA এবারের ভোটে প্রভাব না পরলেও এই ৫০ লক্ষ ভোটারের নাম ভোটার তালিকায় ওঠার পর একটা প্রভাব পড়া সম্ভাবনা রয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.