সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: একেবারে খোলনলচে ভোলবদল হচ্ছে রাজের ১২ চিড়িয়াখানার। ‘ফুল ভিশন’ নিয়ে ২০ বছরের নিরিখে নতুন ভাবে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে নবরূপে সাজানো হবে রাজ্যের মিনি জু থেকে পূর্ণাঙ্গ চিড়িয়াখানাগুলোকে। যা আগামী জুলাই থেকেই পর্যায়ক্রমে নতুন চেহারায় বদলাতে শুরু করবে।
এই ১২ চিড়িয়াখানার মধ্যে ইতিমধ্যেই কলকাতার হরিণালয় ও শিলিগুড়ির বেঙ্গল সাফারির মাস্টার প্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছে সেন্ট্রাল জু অথরিটি। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে সুরুলিয়া মিনি জু পরিদর্শন করতে এসে এই সুখবর জানান ওয়েস্ট বেঙ্গল জু অথরিটির সদস্য সচিব সৌরভ চৌধুরী। কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এই অনুমোদন দেওয়ায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হরিণালয়ে বাঘ-বাঘিনী ও সিংহ-সিংহী আসছে। যা পুজোর আগেই দর্শন করতে পারবেন দর্শকরা।
জঙ্গলমহল ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়ার সুরুলিয়া মিনি জু-কে ওই এলাকার ল্যান্ডস্কেপ অনুযায়ী অর্থাৎ বিস্তীর্ণ ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকায় যে ধরনের বন্যপ্রাণ রয়েছে তা রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এনে সাজানো হবে। বনমহল পুরুলিয়ার পাশের জেলা বাঁকুড়া ও পশ্চিম বর্ধমানে কোন চিড়িয়াখানা না থাকায়
সুরুলিয়ার মিনি জুকে পূর্ণাঙ্গ চিড়িয়াখানার প্রস্তাব দিয়ে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনা হচ্ছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল জু অথরিটির সদস্য সচিব সৌরভ চৌধুরি বলেন, “রাজ্যের ১২ চিড়িয়াখানার মাস্টার প্ল্যান
অনুযায়ী একেবারে খোলনলচে বদলে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই হরিণালয় ও বেঙ্গল সাফারির
মাস্টার প্ল্যানের অনুমোদন আমরা পেয়ে গিয়েছি। তাই হরিণালয়ে একজোড়া বাঘ ও সিংহ আসছে। যা পুজোর সময় থেকেই দর্শকরা দেখতে পাবেন।”
এই বাঘ-বাঘিনী নিয়ে আসা হচ্ছে বেঙ্গল সাফারি থেকে। ভিন রাজ্য থেকে আসছে সিংহ। সিংহী দেওয়া হবে অবশ্য আলিপুর থেকেই। পুরুলিয়ার সুরুলিয়া যেহেতু পূর্ণাঙ্গ চিড়িয়াখানার প্রস্তাব রয়েছে তাই এখানে চিতা বাঘ, ম্যাকাও ছাড়াও নতুন করে একাধিক ভল্লুক, নেকড়ে আরও একটি হায়না নিয়ে আসা হবে। এমনকি আগামী দিনে বাঘ ও সিংহ আনারও পরিকল্পনা রয়েছে। সদস্য সচিবের কথায়, “জঙ্গলমহল পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের ক্ষেত্রে আমাদের ‘থিম’ হল সেখানকার ল্যান্ডস্কেপে যে সকল বন্যপ্রাণ আছে তাদেরকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে এসে ডিস প্লে করা। পুরুলিয়ায় যেমন বাঘ রিপোর্ট হয়েছে। তেমনই লেপার্ড, নেকড়ে, হায়না তো আছেই।জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সমীক্ষায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ শ্রেণীর এক নম্বরে থাকা মেড্রাস ট্রি শেরো দেখা গিয়েছে। যা একেবারে বিরল। ফলে সুরুলিয়ার চিড়িয়াখানাকে এই বনমহলের থিমেই তুলে ধরা হবে।” এদিন সুরুলিয়া মিনি জুতে পুরুলিয়ার বনদপ্তরের চার বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়। এই বৈঠকে যেমন ইঞ্জিনিয়াররা ছিলেন। ছিলেন বিজ্ঞানসম্বন্ধীয় বিশেষজ্ঞরাও।
আগে এই চিড়িয়াখানা গুলোর ক্ষেত্রে ১০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হতো। কিন্তু এবার তা বদলে ২০ বছরের নিরিখে সুসংহত পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। কি থাকছে এই মাস্টার প্ল্যানে? মাংসাশী এবং যেসকল বন্যপ্রাণ মাংসাশী নয় তাদেরকে আলাদাভাবে ডিসপ্লে করা। সেই সঙ্গে পাখিদের ডিসপ্লেও থাকবে একেবারে পৃথক। এছাড়া জঙ্গলমহলের ডিসপ্লেতে সেখানকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে থাকবে অন্যরকম ‘সারপ্রাইজ’। কোন চিড়িয়াখানাতেই আর আগের মত একসাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বন্যপ্রাণ, পাখি থাকবে না। আলিপুর চিড়িয়াখানার ক্ষেত্রে যা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। পাখির সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ডিসপ্লে এমনভাবে করা হয়েছে যা ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা পক্ষী চিড়িয়াখানার মর্যাদা পেয়েছে।
এছাড়া এই চিড়িয়াখানাতে আরও নতুন-নতুন বন্যপ্রাণকে নিয়ে আসা হচ্ছে। এই চিড়িয়াখানার মাস্টার প্ল্যান আগেই জমা পড়েছে। এখন অনুমোদন শুধু সময়ের অপেক্ষা। একইভাবে জমা হয়েছে সুন্দরবন বন্যপ্রাণী পার্ক, ঝড়খালি ও কোচবিহার রসিকবিল মিনি চিড়িয়াখানার সুসংহত পরিকল্পনা। মাস্টার প্ল্যান জমা হবে দার্জিলিং, হাওড়ার গড়চুমুকের। এছাড়া আলিপুরদুয়ারের দক্ষিণ খয়েরবাড়ি মিনি চিড়িয়াখানা, বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম ও সুরুলিয়া মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়ে আগামী মাসে সেন্ট্রাল জু অথরিটির কাছে জমা হয়ে যাবে। যা জুন মাসের মধ্যেই অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবে বলে রাজ্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ আশাবাদী। এছাড়া মালদার আদিনা ডিয়ার পার্ক নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে।
ডিসপ্লের বিষয়টি ছাড়াও বন্যপ্রাণের এনক্লোজার, খাঁচা গুলোকে একেবারে প্রাকৃতিক রূপ দেওয়া হবে। সেখানে যেমন গাছ থাকবে। তেমনই থাকবে বন্যপ্রাণ অনুযায়ী খেলাধূলার সামগ্রী। লুকিয়ে থাকার জায়গাও। পাখির খাঁচাগুলোতে থাকবে ফলের গাছ। সুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের মতো চিড়িয়াখানা গুলোতে যেখানে দাবদাহের সঙ্গে বন্যপ্রাণ লড়াই করতে পারে সেই পরিকাঠামোও তৈরি করা হবে। থাকবে স্প্রিংলঙ্কার, ফ্লোয়িং ওয়াটার। তাদের খাওয়া-দাওয়া, বাসস্থান যাতে একেবারে জঙ্গলের মধ্যেই প্রাকৃতিক হয়। সেই দিকটাতে সবচেয়ে বেশি নজর দিয়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের সংস্পর্শ কমানো হবে। খাবার পরিবেশনে যাতে কোনোভাবেই মানুষের হাতের ছোঁওয়া না থাকে। খাবার দেওয়া হলে মাংস কখনোই টুকরো টুকরো করে দেওয়া হবে না। তারা পরিশ্রম করে যাতে খেতে পারে। যেমনটা জঙ্গলে নিজের মতো করে বন্যপ্রাণ ‘ডমিনেশন’ করে। এনক্লোজার এবং খাঁচার মধ্যে একেবারে স্বাধীন থাকবে তার বন্দোবস্ত করবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
ন্যাচারাল, ফুড ও হ্যাবিটেট এনরিচমেন্ট-র ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করা হবে। এছাড়া মাস্টার প্ল্যানে থাকবে কনজারভেশন ব্রিডিং। যা সংশ্লিষ্ট এলাকার মুখ্য বনপাল আলোচনার ভিত্তিতে যে বন্যপ্রাণের বংশবিস্তারের কথা বলবেন সেটাই নথিভুক্ত হবে ওই পরিকল্পনায়। পৃথকভাবে থাকবে এ্যানিমেল ম্যানেজমেন্ট, মেন ম্যানেজমেন্ট, বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ব্যবস্থা, জু আউটরিচ এডুকেশন, কালেকশন প্ল্যান, কনজারভেশন ব্রিডিং। অর্থাৎ প্রত্যেকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বিভাগে জোর। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া ঘুরে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সদস্য সচিব শুক্রবার যাবেন বর্ধমানে।
নয়া মাস্টারপ্ল্যানের খতিয়ান
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.