সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: চারে তিন। মঙ্গলবার এই মার্কশিট হাতে পেয়ে সত্যিই হাসছে জঙ্গলমহল। পুরনো জমি যে পুনরুদ্ধার হয়েছে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম – চার আসনের মধ্যে একমাত্র পুরুলিয়া আসনটিই হাড্ডাহড্ডি লড়াইয়ের পর নিজেদের দখলে রেখেছে বিজেপি। এছাড়া তিন আসনে একেবারে সবুজ ঝড়। দিলীপ ঘোষের ছেড়ে যাওয়া মেদিনীপুর কেন্দ্র ধরে রাখতে ব্যর্থ অগ্নিমিত্রা পল। বিধানসভার মতো লোকসভায় এই আসনেও পদ্মশিবির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তারকা প্রার্থী জুন মালিয়া। পদ্ম নয়, ঝাড়গ্রামবাসী আস্থা রেখেছেন পদ্ম-পুরস্কারপ্রাপ্ত ঘাসফুল শিবিরের সাহিত্যিক প্রার্থী কালীপদ সোরেনের উপর। আর বাঁকুড়ায় প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়েছেন বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার। জিতেছেন দক্ষ সংগঠক তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে সবুজ জঙ্গলমহলের রং হয়ে গিয়েছিল গেরুয়া। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া – সব কটি আসনই গিয়েছিল বিজেপির দখলে। অপ্রত্যাশিত ফলাফল হয়েছিল শাসক শিবিরের। কারণ পর্যালোচনা করতে গিয়ে উঠে এসেছে অনেক কিছুই। উনিশের লোকসভা লড়াইয়ের মার্কশিটে শূন্য পাওয়ার পর থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেছিল রাজ্যের শাসকদল। একুশের ভোটে সেই খরা খানিকটা কেটেছিল। বিশেষত ঝাড়গ্রামের (Jhargram) রাজনৈতিক মানচিত্র বদলাতে থাকে। সাতটির মধ্যে সাতটি বিধানসভাতেই জয়ী হয় তৃণমূল (TMC)।
সেই ছিল শুরুর শুরু। তার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজ্য সরকারের একের পর এক উন্নয়নমূলক প্রকল্প জঙ্গলমহলের (Junglemahal) দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষজনের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়াই ম্যাজিকের কাজ করেছিল ঘাসফুল শিবিরে। বিশেষত ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পে মহিলাদের মাসে ১০০০ টাকা প্রাপ্তি, পরিবারের জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’, ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ায় পদ্ম শিবিরের প্রতি আস্থা ধীরে ধীরে হারিয়েছিলেন আমজনতা। তারই সুফলে ঝাড়গ্রামের গেরুয়া রং নিমেষে বদলে গেল সবুজে।
২০১৯-এ ঝাড়গ্রামের তৃণমূল প্রার্থীকে নিয়ে জনতাই ছিল ক্ষুব্ধ। সেসময়কার প্রার্থী বীরবাহা সোরেনের স্বামীর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের উদ্দেশে অপমানজনক মন্তব্যের অভিযোগ ভোট বাজারে একেবারে আগুনে ঘি পড়েছিল। ফলে মুখ ফিরিয়ে সিংহভাগ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন আস্থা রেখেছিলেন পদ্মপ্রার্থী কুনার হেমব্রমের প্রতি। কিন্তু চব্বিশে ঘাসফুল শিবিরের প্রার্থী পদ্ম পুরস্কারজয়ী কালীপদ সোরেন ঝাড়গ্রামবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। অবশ্য বিজেপি (BJP) প্রার্থী ডাক্তার প্রণত টুডুও ধারেভারে কম নন। তিনিও এলাকার জনপ্রিয়, পরিচিত চিকিৎসক। তার উপর ভোটের দিন আক্রান্ত হয়ে, নিরাপত্তারক্ষীর মাথা ফেটে যাওয়ার মতো ঘটনার মুখে পড়েছিলেন প্রণত টুডু। এই সংগ্রামের প্রতিফলন ভোটবাক্সে হয়নি। এখানে যত না প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থীর লড়াই, তার চেয়ে দলে দলে যুদ্ধের গুরুত্ব ঢের বেশি। আর সেই ফর্মুলায় বাজিমাত করল শাসকদল।
ঝাড়গ্রামের মতোই বাঁকুড়া, মেদিনীপুরও বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। ফ্যাক্টর সেই একই। শাসকদলের উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধা। আর মেদিনীপুরের দুই তারকা প্রার্থী জুন মালিয়া ও অগ্নিমিত্রা পলের মধ্যে জুনের জনপ্রিয়তার উপর ভরসা ছিলই। তাঁকে বিধানসভা থেকে লোকসভা পাঠালেন মেদিনীপুরের ভোটাররা। পুরুলিয়ায় (Purulia) উনিশে প্রবল গেরুয়া হাওয়া ছিল। যার জোরে দিল্লির পথে পা বাড়িয়েছিলেন বিজেপির জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো। ২০১৯, ২০২১-এ যেভাবে সাবেক মানভূমের জমি শক্ত করেছিল বিজেপি, চব্বিশের সেই ভিত নড়ে গিয়েছে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, সহজ-সরল কাজের মানুষ শান্তিরাম মাহাতোকে এবার বিজেপি প্রার্থীকে বেশ চাপে রেখেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ আর লড়াইয়ের ময়দান আঁকড়ে থাকতে পারেননি। পুরুলিয়ায় ফের গেরুয়া ঝড় তুলে দখলদারি বজায় রেখেছেন জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো (Jyotirmoy Singh)।
কুড়মিদের (Kurmi) আলাদাভাবে সংসদীয় রাজনীতির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ হতেই পারত রাজনৈতিক রং বদলের বড় ফ্যাক্টর। তবে কুড়মিদের সমর্থনও ঘাসফুলের দিকে ঘেঁষেছে। তারও কারণ আছে বিস্তর। দিলীপ ঘোষের কুড়মিদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য, তফসিলি জাতির তকমা পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের আন্দোলনে কেন্দ্রের অসহযোগিতা, আশ্বাসহীনতায় বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়েছেন জনজাতির মানুষজন। ফলে সহজ অঙ্কে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক বেড়েছে। বাঁকুড়ায় (Bankura)বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে দলের অন্দরে বিরোধিতা ছিল। উলটোদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের দক্ষ সংগঠক, ভূমিপুত্র অরূপ চক্রবর্তী বেশ এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। শেষপর্যন্ত তাঁর কাছেই হারতে হল বিদায়ী মন্ত্রীকে। সবমিলিয়ে, এবারের লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলের চারের মধ্যে তিনটি আসন দখল তৃণমূলের বড় সাফল্য নিঃসন্দেহে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.