দীপালি সেন: ইংরেজিতে মিস, মিসেস বা মিস্টার। বাংলায় কুমারী, শ্রীমতী বা শ্রী। পুরুষ না মহিলা, নিজের লিঙ্গ পরিচিতি বোঝাতে বেছে নিতে হয় যে কোনও একটি। মহিলাদের ক্ষেত্রে বিবাহিত না অবিবাহিত, সেই ঘোষণাও করতে হয় নামের আগে থাকা এই লিঙ্গ পরিচয়ের মাধ্যমে। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি তৃতীয় লিঙ্গের হন! সেক্ষেত্রে নামের আগে থাকা মিস্টার বা মিস-মিসেস চয়নের মাধ্যমে ছেলে বা মেয়ে হিসাবে নিজেদের ঘোষণা করতে বাধ্য হন তাঁরা। যা নৈতিক দিক থেকে সঠিক নয় বলে মনে করছে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। তাই ২০২৩-’২৪ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে নামের আগে এভাবে লিঙ্গ সত্তা ঘোষণার অপশনগুলি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ছে সংসদের তরফে।
সত্তা মেয়ের। শরীর পুরুষের হওয়ায় বাধ্য হয়ে চয়ন করতে হয়েছিল পুরুষ লিঙ্গ। করতে হয়েছিল সমঝোতা। তাই উচ্চমাধ্যমিকের মেধাতালিকায় সপ্তম স্থানাধিকারী শরণ্যার (শরণ্য ঘোষ) নামের পাশে লিঙ্গের জায়গায় লেখা ছিল ‘এম’ তথা পুরুষ। ২০২৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের আর শরণ্যার মতো সমঝোতা করতে হবে না। কারণ, ২০২২ সালে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশনে এক ‘যুগান্তকরী পদক্ষেপ’ নিয়েছিল উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। পুরুষ ও মহিলার সঙ্গে লিঙ্গ পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছিল ‘অন্যান্য’ অপশন। ফলস্বরূপ মহিলা বা পুরুষের ছদ্দবেশ না নিয়ে স্বপরিচয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন শ’পাঁচেক পড়ুয়া। তাঁরা ২০২৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু, লিঙ্গের ক্ষেত্রে স্বপরিচয় ঘোষণা করলেও রেজিস্ট্রেশন ফর্মে নামের আগে মিস, মিসেস বা মিস্টার অপশনের মধ্যে একটি চয়ন করে নিজেদের মেয়ে অথবা পুরুষ হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মিস্টার-মিসেস বা শ্রী-শ্রীমতী উঠছে পড়ুয়াদের নামের আগে।
চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য বলেন, “গত বছর একাদশ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনে প্রথমবার লিঙ্গ পরিচিতিতে ‘অন্যান্য’ অপশন রাখা হয়েছিল। কিন্তু, নামের আগে এই মিস-মিসেস, মিস্টার অপশন ছিল। ফলে কেউ অন্যান্য লিঙ্গ নির্বাচন করলেও তাকে মিস্টার বা মিস-মিসেস পছন্দ করতে হত। অর্থাৎ তাঁকে নিজেকে ছেলে অথবা মেয়ে হিসাবে ঘোষণা করতে হত। সেটা তো ঠিক নয়।” সেকারণেই ২০২৩-’২৪ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন থেকে অপশনগুলি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিরঞ্জীববাবু। আগামী ১৬ আগস্ট থেকে শুরু হবে একাদশের পড়ুয়াদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া।
২০২৩ সালের উচ্চমাধ্যমিকের মেধাতালিকায় স্বপরিচয় ঘোষণা করতে পারেননি শরণ্যা। কিন্তু, সমাজিক বিধিনিষেধ, সংস্কৃতির বেড়া থেকে মুক্ত হয়ে আগামী বছর থেকে ‘অন্যান্য’দের যে আর সমঝোতা করতে হবে না, তা জেনে বেজায় খুশি তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘খুবই ভাল উদ্যোগ। পুরুষ ও মহিলা, এই দুইয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যে আরও লিঙ্গ পরিচয় রয়েছে, তা স্বীকৃতি পাচ্ছে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব অস্তিত্ব, পরিচিতি রয়েছে। রয়েছে তা নির্বাচনের স্বাধীনতা। সরকারিভাবে নেওয়া এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন অনুপ্রাণিত করবে, তেমনই সচেতনতা গড়ে তুলবে। তার দরুণই এবার রূপান্তরকামী, তৃতীয় লিঙ্গ বা অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের পড়ুয়ারা এগিয়ে আসবে।”
প্রসঙ্গত, গত বছর একাদশ শ্রেণিতে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে রেজিস্ট্রশন করা প্রায় ৫০০ পড়ুয়ার মধ্যে চারশোর কাছাকাছি কলা শাখার বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন। বাকিরা বাণিজ্য ও বিজ্ঞান শাখার। তাঁদের মধ্যে শরণ্যার মতো কোনও কৃতী থাকলে পরের বছরের উচ্চমাধ্যমিকের মেধাতালিকায় তাঁর নামের পাশে থাকবে না ‘এম’ বা ‘এফ’ অক্ষরগুলি। প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে চান শরণ্যা। উচ্চশিক্ষায় নিজের লিঙ্গ পরিচয়ে ‘অন্যান্য’ অপশন বেছে নেবেন তিনি। শরণ্যার কথায়, ‘‘আমার যেটা পরিচয় সেটাই সবার সামনে প্রকাশ করব। আমার নামের পাশে ভুল লিঙ্গ পরিচয় দাগিয়ে দেওয়া হবে না। অবশ্যই আমার ভাল লাগছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.