সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: পুরভোটে সবুজ ঝড়ে গড়হীন হেভিওয়েটরা। বিধানসভা ভোট থেকেই রাজ্যে ধাক্কা খেয়েছিল গেরুয়া শিবির। দলীয় কাঠামোয় ঘুণ ধরেছিল বিজেপির। পুরভোটে (WB Civic Polls 2022 Result) সেই ঘুণ ধরা কাঠামো যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সর্বভারতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষ, দাপুটে সাংসদ অর্জুন সিং, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর খাসতালুকে খাতা খুলতে ব্যর্থ হল বিজেপি। শুধু বিজেপি নয়, লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর বহরমপুরেও বোর্ড গড়তে ব্যর্থ তাঁর দল। সবমিলিয়ে রাজ্যের শাসকদলের উন্নয়নের জোয়ারে খড়কুটোর মতো ভেসে গেলেন বিরোধী নেতারা।
বাংলার মানচিত্রের নিরিখে প্রথমেই বলতে হয় বালুরঘাট পুরসভার কথা। বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বালুরঘাটের সাংসদ। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও ভাল ফল করেছিল বিজেপি। লোকসভা এবং বিধানসভা দুই নির্বাচনের নিরিখেই পুরসভার ওয়ার্ডগুলিতে এগিয়ে ছিল পদ্মশিবির। কিন্তু তার পর থেকেই এই এলাকায় গেরুয়া হাওয়া ফিকে হতে শুরু করে। পুরভোটেও সেই ধারা বজায় রইল। পুরভোটের দিন নিজের এলাকায় কার্যত দাপিয়ে বেরিয়েছিলেন সুকান্তবাবু। তার পরেও বালুরঘাট পুরসভার ২৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৩টি জিতে নিল তৃণমূল। দুটি পেল বামেরা। আর বিজেপির হাতে রইল পেন্সিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুকান্ত মজুমদারের নিজস্ব ওয়ার্ড ২২ নম্বরেও জিততে পারেনি বিজেপি।
এর পর বলতে হয় মুর্শিদাবাদের বহরমপুর পুরসভার কথা। ১৯৯৮ সাল থেকে অধীর চৌধুরীর গড় হিসেবে পরিচিত এই এলাকা। ৩০ বছর ধরে কংগ্রেসের হাতে রয়েছে বহরমপুর পুরসভা। গত পুরভোটে ২৮ আসনের মধ্যে ২৬টিতে জিতেছিল কংগ্রেস। ২টি ওয়ার্ড ছিল তৃণমূলের হাতে। কিন্তু ২০১৬ সালের শেষের দিকে কংগ্রেসের ক্ষমতাশালী কাউন্সিলররা দলবদল করেন। ফলে বোর্ডের দখল নেয় তৃণমূল। এদিকে ২০১৯ সালে লোকসভা কেন্দ্রে জিতেছিলেন অধীর চৌধুরী। বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে জিতেছিল বিজেপি। সেই নিরিখে একাধিক ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস। কিন্তু পুরভোটে ম্লান হয়ে গেল বিরোধীরা। ভোটের দিন লড়াই করেও গড়রক্ষা করতে পারলেন না অধীর। এমনকী, নিজের পাড়া ২ নম্বর ওয়ার্ডে ধাক্কা খেল কংগ্রেস। মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হল হাত শিবিরকে। আর বিজেপি তো খাতাই খুলতেই ব্যর্থ হল বহরমপুরে।
এবার নজর রাখা যাক বিজেপির দাপুটে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের গড়ে। সেখানেও আহামরি ফল করতে পারেনি গেরুয়া শিবির। অথচ ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে খড়গপুর পুরসভার প্রায় সমস্ত ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বিজেপি। যদিও লোকসভা উপনির্বাচনে সেই জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ে। কিন্তু বিধানসভা ভোটে সেই কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে জয় পান অভিনেতা হিরণ চট্টোপাধ্যায়। পুর ওয়ার্ডেও ভোটের নিরিখে বেশকিছুটা এগিয়ে ছিল পদ্মশিবির। কিন্তু পুরভোটে সেই সমর্থনকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হল তারা। কোনওমতে বিধায়ক হিরণ নিজের আসনে জয় পেলেও পুরবোর্ড গড়তে পারল না বিজেপি। ৩৫ ওয়ার্ডের পুরসভায় বিজেপিকে মাত্র ৬টি আসন পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হল। উল্লেখযোগ্যভাবে বিজেপির সমসংখ্যক আসন পেল কংগ্রেসও।
বারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংয়ের গড়েও বড় ধাক্কা খেল পদ্মশিবির। কাঁচরাপাড়া থেকে টিটাগড় এই ৮টি পুরসভায় খাতাই খুলতে পারেনি বিজেপি। অথচ ২০১৯ সালের লোকসভার পর থেকে এই এলাকায় বিজেপির প্রতি জনসমর্থন তৈরি হয়েছিল। বিধানসভা ভোটেও সেই সমর্থনে ভাঁটা পড়লেও মুখরক্ষা করেছিল তারা। কিন্তু পুরভোটের আগেই ভাগ্নে, ভাইপো-সহ একাধিক আত্মীয় শিবির বদল করে বিজেপির প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেন অর্জুন। তার ফলে গাড়ুলিয়ার একাধিক ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থীই ছিল না। ভোট দিতে পারেননি খোদ অর্জুনও। ভোটের দিন এলাকায় এলাকায় ‘গুন্ডামি’ করতে দেখা গিয়েছিল তাকেও। ফল বেরতেই দেখা গেল অর্জুনের সব জারিজুরি উধাও। ৮ পুরসভায় টিকিই মিলল না পদ্মশিবিরের।
দীর্ঘদিনের গড় রক্ষা করতে ঘুরপথে কম চেষ্টা করেনি কাঁথির অধিকারী পরিবার। কিন্তু পুরসভা ভোটে (WB Civic Polls 2022) রাজ্যজুড়ে সবুজ ঝড়ের কাছে শেষমেশ অধিকারী গড় ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতোই। চার দশক পর অধিকারী পরিবারের হাতছাড়া কাঁথি পুরসভা (Kanthi Municipality)। ২১ টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র দুটিই দখলে আনতে পেরেছে গেরুয়া শিবির। ১৮টি ওয়ার্ডে হইহই করে জিতলেন তৃণমূল প্রার্থীরা। একটি ওয়ার্ড গিয়েছে নির্দলের দখলে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরাজয় শুভেন্দু শিবিরের প্রার্থী, উত্তর কাঁথির বিধায়ক সুমিতা সিংহের। তিনি ৬ নং ওয়ার্ড থেকে হেরেছেন তৃণমূল প্রার্থীর কাছে। সবমিলিয়ে রাজ্যের শাসকদলের প্রতি মানুষের আস্থা বিরোধী নেতাদের দর্পচূর্ণ করল। বুঝিয়ে দিল, রাজনীতিতে ‘গড়’ বলে কিছু হয় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.