সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ভোটে (WB Panchayat Poll 2023) কী যায় আসে ভোটারহীন গ্রামের! শাল-পিয়ালের জেলায় যেখানে শুধুই বাঁশের জঙ্গল, তার নাম কি বাঁশগড় ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে। যা আসলে এক সময়ের মাওবাদীদের গড়ও। সেই গাঁয়ের নাম তো আর প্রশাসনের খাতা থেকে মুছে যায়নি। সেখানে পৌঁছনোর ঝাঁচকচকে রাস্তা আছে। সরকারি মাইলফলকেও জ্বলজ্বল করছে ‘বাঁশগড়’। আছে গ্রামের নামে বোর্ড। কিন্তু ২১ বছর ধরে এই গ্রাম যে ভোট দেয় না। সেই গ্রাম যে ভোটারশূন্য।
পুরুলিয়ার ঝালদা দু’নম্বর ব্লকের চিতমু গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামটি কোটশিলা থানা এলাকা থেকে প্রায় ১৯ কিমি দূরে। ১৮৩.১৯ হেক্টর জুড়ে এই এলাকা। চাষাবাদের জমি ৪৬.৫৪ হেক্টর। তবু কেন আজ ভোটারশূন্য এই গ্রাম? আজ থেকে দু’দশক আগের কথা। জমিদার একান্নবর্তী তিওয়ারি পরিবারের সদস্যরাই একমাত্র ভোটার ছিলেন। তবে তাঁরা ভোট দিতে যেতেন পাশের তাহেরগড়ে। সময়টা ২০০২ সালের ২৬ নভেম্বর। মঙ্গলবার। তখন প্রায় বিকেল। তার পর থেকেই বদলে যায় বাঁশগড়ের ভোটের ছবি। ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে গ্রাম। সেদিন জয়পুর থেকে হাটবাজার সেরে বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছেছেন জোতদার-জমিদার জগদীশ তিওয়ারি। তঁার পথ আটকে ঘিরে নেয় প্রায় ২০০জন বন্দুকধারী নকশাল। দড়ি দিয়ে বেঁধে পিছমোড়া করে বন্দুকের বঁাট দিয়ে মারতে মারতে ওই জমিদারকে দুর্গামন্দিরের কাছে নিয়ে যায়। সেখানেই পরিবারের সদস্যদের সামনে হাড়িকাঠে বলি দেয় এমসিসি (মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার )।
তখনও সিপিআই (মাওবাদী) গঠন হয়নি। বন্দুকধারী ওই নকশালদের ভয়ে স্ত্রী, ছেলেদের চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে হয়েছিল। দুর্গাঠাকুর দালান ভেসে গিয়েছিল রক্তে। তারপর ওই জমিদার পরিবারের সদস্যদের মারধর করে এক জায়গায় রেখে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র-সহ গৃহস্থালি জিনিসপত্র লুট করে। প্রাসাদসম দোতলা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলার জরিডির পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে আসা ওই নকশালরা। চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, এই এলাকায় তাদের সংগঠনের কার্যালয় হবে। এটাই ছিল জঙ্গলমহলে নকশালদের প্রথম হিংসার ছবি।
নিহত জগদীশ তিওয়ারির মেজ ছেলে জন্মেজয় তিওয়ারি বলেন, “তখন আমার বয়স ২০ বছর হবে। বাবার সঙ্গে আমি জয়পুর গিয়েছিলাম। বিকেলের পর আর বাড়ি ফিরিনি। আমি রাস উৎসব দেখার জন্য পুরুলিয়া গিয়েছিলাম। তারপরেই এই ঘটনা ঘটে যায়। গ্রাম ছাড়ার পর আর আমরা ওখানে যাইনি। আমাদের পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ি-সহ যে ২৩ একর জমি ছিল তার মধ্যে তিন-চার একর বাদ দিয়ে সবকিছু বছর আড়াই আগে আনন্দমার্গীদের বিক্রি করে দিয়েছি মাত্র আট লক্ষ টাকায়। আগে আমরা ওই গ্রামের পাশে তাহেরবেড়া বুথে ভোট দিতাম। তবে আর কোনওদিন আমরা ওখানে ফিরতে চাই না। আমাদের কাছে অভিশপ্ত হয়ে আছে ওই বাঁশগড়। আমাদের পরিবার এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কোটশিলা, পুরুলিয়া শহর ও রাঁচিতে থাকে। এখন ভোট দিই কোটশিলায়।”
পুরুলিয়ার জেলাশাসক রজত নন্দা বলেন, “বাঁশগড় গ্রাম বর্তমানে ভোটার শূন্য ঠিকই। তবে ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে আমরা পর্যটন প্রকল্প হাতে নেব।” ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা এই গ্রাম যে ছবির মতোই সুন্দর। পা রাখলেই শোনা যায় ময়ূরের ডাক। এমনই ল্যান্ডস্কেপে ভোটার শূন্য। দু’পাশে পাহাড়ের বুক চিরে কালো পিচ রাস্তা যায় ওই গ্রামে। যেখানে শেষ হয় ওই রাস্তা। সেখানে মাইলফলক-এ লেখা থাকে বাঁশগড় শূন্য। তারপরেই যে জঙ্গলের পথ। সেখানেই ছিল ওই জগদীশ তেওয়ারির অভিশপ্ত বাড়ি। পুড়ে যাওয়া ওই বাড়ির যে ভাঙাচোরা অংশ ছিল সেই ইট-পাথর দিয়ে জঙ্গলের পথে রাস্তা তৈরি করেছেন ওই আনন্দমার্গীরা। রক্তভেজা মাটিতে তৈরি করেছেন ফার্ম হাউস। সেই সঙ্গে দূরে থাকা তাদের স্কুলের ছাত্রাবাসও রয়েছে ওই ভবনে। হচ্ছে নানান পরীক্ষামূলক চাষাবাদ।
সেখানে থাকা ওই সংঘের আচার্য সুরেশান্দ অবধূত বলেন, ” বছর আড়াই আগে আমরা ওই তেওয়ারির পরিবারের কাছ থেকে তাদের সম্পত্তি কিনে নিয়েছি। এখন এটা আমাদের ফার্ম হাউস।” কিন্তু আগের ছন্দে কি ফিরবে বাঁশগড়? ভোটের আবহে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খায় ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা এই পাহাড়তলিতে। কিন্তু বাঁশগড়ের ইতিহাসে যে রয়ে গিয়েছে শুধুই রক্তের দাগ। গ্রামের নাম ছাড়া যে আর কিছুই নেই!
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.