সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: বছর সাতেক আগে পুরুলিয়ার (Purulia) কোটশিলা বনাঞ্চলের টাটুয়াড়ায় নৃশংসতার ছবি দেখেছিল গোটা দেশ। সেই কোটশিলা বনাঞ্চলেই বনদপ্তরের লাগাতার সচেতনতা প্রচারের ফল – উলটো ছবি। প্রায় দু’বছর ধরে কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিটের জঙ্গলে চিতাবাঘ ঘাপটি মেরে থেকে একের পর এক গবাদি পশুকে মেরে ফেললেও ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পুরুলিয়ার এই জনপদ চায়, ওই বন্যপ্রাণীর যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। তাঁরা চিতাবাঘটিকে (Leopard) বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া। চাইছেন, গ্রামের জঙ্গলেই থাকুক চিতা, শুধু লোকালয়ে না এলেই হল।
পেটের টানে জঙ্গলে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে গেলেও কখনওই কোনও অস্ত্র, লাঠিসোঁটা নিয়ে যান না সিমনি বিটের জাবর, সিমনি, তহদ্রি, হরতান, কাড়িয়ার এলাকার মানুষজন। লোকালয়ের পাশের বনে চিতাবাঘ রয়েছে, এই আশঙ্কা করেও তাঁরা বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চান না। বরং তারা চান, ওই বাঘ যেন তাঁদের গ্রাম লাগোয়া জঙ্গল ছেড়ে না যায়। রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) তথা চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন দেবল রায় বলেন, “ওই চিতাবাঘ দীর্ঘদিন ধরে কোটশিলা বিটের সিমনি এলাকায় থেকে যেভাবে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, ফলে এটাই প্রমাণ করে ওই এলাকার মানুষজন জঙ্গলে থাকা বন্যপ্রাণের মর্যাদা রাখতে জানেন।”
২০১৮ সালের এই মার্চ মাসেই ঝাড়গ্রামে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার (Royal Bengal Tiger) ঢুকে যাওয়ার পর সেখানে ওই বন্যপ্রাণকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। ২০১৫ সালের ২০ জুন এই বনাঞ্চলের টাটুয়াড়ায় সাতসকালে লোকালয়ে চলে এসেছিল একটি চিতাবাঘ। এলাকার মানুষজন তাড়া করায় এক গৃহস্থের বাড়ির শৌচাগারে ঢুকে পড়ে। সেই খবর রটে যেতেই সেখানে আসে পুলিশ। এক পুলিশ আধিকারিক ওই শৌচাগারের দরজা খুলতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিতা। জখম হন তিনি। এরপরেই গ্রামের শত শত মানুষ লাঠিসোটা, ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাড়া করে তাকে পিটিয়ে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেয়l কেটে নেয় পা। উপড়ে নেওয়া হয়েছিল নখ। কেটে দিয়েছিল পুরুষাঙ্গও।
তখন থেকেই এলাকার মানুষজন দাবি করতে থাকেন, আরও চিতাবাঘ রয়েছে। তারপর বনদপ্তর চিতাবাঘ খুঁজতে জঙ্গল জুড়ে তল্লাশি চালালেও কোনও খোঁজ মেলেনি। তবে এর মধ্যে বাঘের একাধিক পায়ের ছাপ এলাকায় পাওয়া যায়। এমনকি গবাদি পশু মেরে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার নমুনাও পেয়েছিল বনদপ্তর। তারপর থেকেই নানান তথ্য আদান-প্রদান হতে থাকে বনাঞ্চলের একাধিক বিট জুড়ে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই কোটশিলা বনাঞ্চলের হরতান থেকে বলরামপুর, বান্দোয়ান বনাঞ্চলের দিকে হেঁটে গিয়েছিল একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। পায়ের ছাপের নমুনা থেকে আন্দাজ করেছিল বনদপ্তর। পুরুলিয়া বিভাগের ডিএফও দেবাশিস শর্মা বলেন, “২০২০ সাল নাগাদ যে পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল তা দেখে দপ্তরের মনে হয়েছে, ওটা রয়্যাল বেঙ্গল। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ থেকেই এই অঞ্চলে ঢুকে পড়েছিল। তারপর কীভাবে কোথা থেকে কোথায় গিয়েছে তা ঠিক পরিষ্কার নয়।এই চিতাবাঘ দেখা পাওয়ার পর আমাদের নজরে রাখতে বলা হয়েছে।”
সিমনি বিটের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া একাধিক গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালের শেষ থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৮ টি গাভী ওই চিতাবাঘের পেটে গিয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দা, কাঠুরিয়া মুকলি মুর্মু বলেন, “আমার পাঁচ-পাঁচটা বাছুর ওই চিতাবাঘটা খেয়ে ফেলেছে। কী আর করব? বনে তো বাঘ থাকবেই।” জঙ্গলে কাঠ কুড়াতে ভয় লাগে না? তাঁর কথায়, “ভয় করলে পেট চলবে কী করে? আমরা আমাদের কাজ করি। আর বাঘ থাকে জঙ্গলে।” সপ্তাহ দুয়েক আগেও এই চিতাবাঘ জাবর গ্রামের অবিনাশ হেমব্রমের গর্ভবতী গাভীকে পিছন থেকে মেরে ‘খুন’ করে। এই নমুনা হাতেনাতে পায় বনদপ্তর। আর তারপর থেকেই হইচই শুরু হয় এই সিমনি বিটে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.