বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: বয়স মাত্র চোদ্দ বছর। তিনবছর আগেও তার পরিবারের কেউ বুঝতে পারেননি কতটা হতভাগী ওই কিশোরী। কারণ তার শরীরে এতদিন জরায়ু থাকলেও ছিল না যোনি বা ভ্যাজাইনা। ফলে যৌবনের লক্ষ্মণ ঋতুক্রিয়ার সময় আসতেই সমস্যা দেখা দেয় কিশোরীর জীবনেl ঋতুক্রিয়া শুরু হলেও তার বের না হতে পারায় মাসের কয়েকটি দিন তার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে হত ওই কিশোরীকে। কেন ওই অসহ্য যন্ত্রণা, তা বুঝে উঠতে উঠতেই কেটে যায় প্রায় আড়াই বছর। পিতৃহীন ওই কিশোরীর বর্তমান অভিভাবক তার মামা কিন্তু শত আর্থিক অনটনের মধ্যেও ভাগ্নিকে নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটেছেন অনেক ডাক্তারের কাছে। সাধ্যমতো খরচও করেন। তবুও ভাগ্নির কষ্ট দূর করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু মিরাকল সত্যিই হয়। তাই তো আজ সেই কিশোরী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে।
[ স্বাধীনতার সাত দশক পরও নেই রাস্তা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে ডুলিই ভরসা রোগীদের ]
জরায়ু রয়েছে, কিন্তু যোনি নেই। এমন কথা কে কবে শুনেছে? ফলে রোগ ধরতে পারছিলেন না কেউ। কিন্তু ডাক্তার ভবতোষ ভৌমিক বোধহয় সিলেবাসে না থাকা সেই বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলেন। হয়তো বা ঝুঁকি নিয়েও তৈরি ছিলেন। তাই কার্যত বিরল অস্ত্রোপচারের পথে হাঁটার সাহস পেলেন তিনি। ওই কিশোরীকে শুধু নতুন জীবনই দিলেন না, তার নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্নটিও পূরণে একধাপ অগ্রসর করে দিলেন। অসম্ভবকে সম্ভব ঘটিয়ে ওই কিশোরীর শরীরে যোনি বসালেন তিনি। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ সেই কিশোরী। ঋতুস্রাবে তার এখন আর কোনও সমস্যা নেই। আগামিদিনে দাম্পত্যজীবনে প্রবেশের পথও খুলে গিয়েছে তার। এবার যৌবনের বয়সে পা দিয়ে মা হতে পারবে ওই কিশোরী।
কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে এই বিরল অস্ত্রোপচার করাটা প্রায় কল্পনাতীত। কিন্তু ভবতোষ ভৌমিক তা সফল করলেন। ৪৫ বছর বয়সী অনেক রোগীর প্রিয় ওই ডাক্তারবাবু তাই বুধবার রাতে ছিলেন ভীষণ খুশি। জীবনের প্রথম বিরল এই অস্ত্রোপাচরের পর তিনি বলেন, “অবশ্যই ভাল লাগছে। কারণ অপারেশন সফল। ওই কিশোরী সুস্থই রয়েছে। এটা আমার জীবনের একটা অন্যতম বড় সাফল্য। ঠিক গর্ব নয়, ওই কিশোরীর মা হওয়ার সম্ভাবনাকে তৈরি করা গিয়েছে, তার জন্যই বেশি ভাল লাগছে।”
[ ‘পুলিশকে দিয়ে অ্যারেস্ট করাব’, হুঁশিয়ারি দিয়ে বিতর্কে টিএমসিপি জেলা সভাপতি ]
কৃষ্ণগঞ্জের বানপূরের বাসিন্দা ওই কিশোরীর জন্মগত ত্রুটি (কনজেনিটাল অ্যাবনর্মালিটি )-র জন্য ভ্যাজাইনা ছিলই না। ভবতোষ ভৌমিক বুঝেছিলেন ওই কিশোরীর মূল সমস্যাটি ঠিক কী। আড়াই মাস আগে সদর হাসপাতালেই ওই কিশোরীর প্রথম অপারেশন করেন। তবে তার আগেই প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ভ্যাজাইনা তৈরি হয়েছিল। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে অ্যাননিয়ন গ্র্যাফটন সেই ভ্যাজাইনা ওই কিশোরীর শরীরে বসানো হয়। এরপর ওই হাসপাতালে কিছুদিন ওই কিশোরীকে রেখে অবজারভেশন করা হয়। তারপর তাকে ছুটি দিলেও প্রতিদিনই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ডাক্তারবাবু। কীভাবে থাকতে হবে, কী ওষুধ খেতে হবে এনিয়ে পরামর্শ দিতেন। এরপর গত রবিবার ওই কিশোরী ফের ভরতি হয় ওই হাসপাতালে। বুধবার আবারও অপারেশন হয় তাঁর। এদিন ভ্যাজাইনার সঙ্গে জরায়ুর সংযোগ করিয়ে চ্যানেল করা হয় এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় পেটের। যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে থ্রু অ্যাবডমিনাল রুট। এর ফলে ওই কিশোরী পরবর্তীকালে মা হতে পারবে।
বিরল ওই অপারেশন করতে খরচ হত অন্তত পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না গরীব ওই কিশোরীর মামার পক্ষে। তাই অপারেশনের জন্য সমস্ত টাকা দিলেন ভবতোষবাবু নিজেই। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ভ্যাজাইনা তৈরি ও অন্যান্য যে খরচ করতে হত, তা একা হাতেই সামলালেন তিনি। সদর হাসপাতালে ওই ডাক্তারকে সহায়তা করলেন অ্যানাস্থেটিস্ট উল্লাস গায়েন ও তিনজন নার্স। সফল ওই অপারেশন করার পর সুস্থ রয়েছে ওই কিশোরী। তার পরিবারের মুখে এখন একটাই কথা, ‘এই প্রথম ভগবানকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হল।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.