ধীমান রায়, ভাতার: মহাশ্মশান, তার পাশে বিল্ব অর্থাৎ বেল এবং বটের বন। বর্ণ বিপর্যয়ে সেই জনপদের নাম হয় বিল্বপত্তন। ক্রমশ তা বদলাতে বদলাতে হয়ে যায় বেলুন। তারপর বড়বেলুন। পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের অন্যতম প্রাচীন গ্রাম বড়বেলুনের বড় মা অর্থাৎ মা কালীর পুজো গোটা জেলার দ্রষ্টব্য।
[আলোর উৎস কালীমূর্তি, কয়েক লক্ষ কাচে প্রতিমায় হরেক চমক]
দুর্গাপুজোর পর ত্রয়োদশীর দিন প্রতিমার কাঠামো তৈরির কাজের সূচনা হয়। ১৮ হাত উচ্চতার বড় কালীর জিভ তৈরি হয় নতুন কুলো কেটে। পুজোর দিন দুপুর থেকে মায়ের বিশালাকার মূর্তিতে রং করা হয় এবং সন্ধ্যায় ডাকের সাজে দেবীকে সাজানো হয়। রাতে মূর্তি গড়ার কাজ করার সময় মশালের আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। প্রায় ৮-৯ ঘন্টা চলে এই পর্ব। বহু মানুষ ওই মন্দির চত্বরে থেকে উপভোগ করেন গোটা বিষয়টি। এসব শেষ হলে বংশের দুই পুরোহিত এসে ভাড়ার উপরে উঠে মায়ের চক্ষুদান করেন। তারপর শুরু হয় পুজো। রাতভর চলে পুজো ও বলিদান পর্ব। পূর্ব বর্ধমান জেলার বড়বেলুন গ্রামে বড়কালীর মাহাত্ম্যের কথা রাজ্যজুড়েই প্রচারিত। এই পুজোয় লক্ষাধিক পুন্যার্থীর সমাগম হয়। দূর-দুরান্তের মানুষ কালীপুজোয় ভিড় জমান বড়বেলুন গ্রামে। বড়বেলুনের ভট্টাচার্য পরিবার এই পুজোর সেবাইত। বর্তমানে ৩৫ টি পরিবার ট্রাষ্টি করে পুজো চালান।
[সতীর পীঠ অট্টহাস সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানেন কি?]
জানা যায় পুজোর সূচনা করেছিলেন সাধক ভৃগুরাম। প্রায় ৬০০ বছর আগে কেতুগ্রামের বহুলা পীঠ থেকে ভৃগুরাম এসেছিলেন এই এলাকায়। ভৃগুরাম ছিলেন অকৃতদার। তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওই এলাকায় শ্মশানের ধারে পর্নকুটির বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। ওই সাধককে বুড়োগোঁসাই নামে ডাকা হত। শোনা যায় দেবীই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিবাহ করতে। সেই আদেশ মেনেই তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। সেই বিবাহ কাহিনিও অদ্ভুত। একদিন বিল্বপত্তনের রাজা নারায়ণ চন্দ্র রায়ের কুমারী কন্যা সর্পাঘাতে মারা যান। সেই রাজকন্যার দেহ বড়বেলুনের শ্মশানে নিয়ে আসা হয় দাহ করার জন্য। দেহটি শ্মশানে পৌছানোর পর ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। শববহনকারীরা শ্মশানে দেহ রেখে একটু দূরে আশ্রয় নেন। ভৃগুরাম মৃতদেহের ওপর শ্মশানের চিতাভষ্ম ছিটিয়ে দিলে আশ্চর্যভাবে বেঁচে ওঠেন রাজকন্যা। শববহনকারীরা পরে এসে দেখেন মৃতা রাজকন্যা জীবিত। কিন্তু সেই পুনর্জন্ম পাওয়া মেয়েকে আর তাঁর পরিবার ও সমাজ নিতে চায়নি। ওই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ভৃগুরাম স্বপ্নাদেশ পান। দেবীর আদেশ তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জনশ্রুতি বলে দেবী সেই সময় বিশালাকায় রূপ ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছিলেন ভৃগুরামকে। তারপর অধুনা বড়বেলুন গ্রামে ১৮ হাত উচ্চতার মূর্তি বানিয়ে পুজো শুরু হয়।
[বেগার খেটেই কালীপুজোয় ‘রাজঋণ’ শোধ করে মেটে সম্প্রদায়]
ভৃগুরামের বংশধরেরাই ২১ পুরুষ ধরে এই পুজো করে আসছেন। শাক্তমতে হয় পুজো। বিশালাকার দেবীমূর্তি রথে চাপিয়ে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ভাতৃদ্বিতীয়ায় ফোঁটা দিয়ে দেবীকে বিসর্জন করা হয় বড়দিঘিতে।
ছবি: জয়ন্ত দাস
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.