চঞ্চল প্রধান, হলদিয়া: রাতেই ‘সূর্যোদয়’! এ যেন এক অন্য আলোর মেলা। যেখানে সবার চোখেমুখে হাজার হ্যালোজেনের ঝলকানি। সবে সন্ধে নামার মুখে যখন হলদিয়া বন্দরের আলোগুলো ঝলমলিয়ে ওঠে, তখন অন্ধকারে ডুবে থাকার দুঃখ নিয়ে রাত কাটাতেন এই মানুষগুলো। নতুন বছরের শুরুর দিনটিকে জীবনের মাইলস্টোন হিসাবে, ‘আঁধার ঘোচানোর সন্ধে’ হিসাবে দাগিয়ে রাখতেই পারেন তাঁরা। স্বাধীনতার এত বছর পর রাজ্যের অন্যতম শিল্পাঞ্চলের দু’টি গ্রাম, সৌতনচক ও বিষ্ণুরামচক পেল বিদ্যুতের আলোর স্বাদ। তা ভাগ করে নিতে উচ্ছ্বসিত মা সন্তান কোলে, প্রৌঢ় মানুষটি হিম মাথায় নিয়েও অনুষ্ঠানে ঠায় বসে।
ট্রান্সফরমারকে সামনে রেখে হল বিশ্বকর্মা পুজো। বিদ্যুৎ সংযোগ ঘটিয়ে প্রথম অরবিন্দ মণ্ডলের বাড়িতে যেই না আলো জ্বলল, আট থেকে আশি সবার সে কী উল্লাস! কারও চোখে আনন্দাশ্রু। আতসবাজি ফাটিয়ে, ঢাক বাজিয়ে চলল লাড্ডু বিলি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee), তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) নামে জয়ধ্বনি। বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্লোগান। আর যাঁর উদ্যোগে এই ‘আঁধার ঘুচিয়ে আলো এল’ সেই তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষকে সামনে পেয়ে সবাই আপ্লুত, কীভাবে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবেন সেটাই ভেবে উঠতে পারছেন না অনেকে।
গত ৪ ডিসেম্বর হলদিয়ায় চায়ের আড্ডা থেকে এই দুই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই জেনে কুণালবাবুই তো গিয়ে পৌঁছেছিলেন বঞ্চিত মানুষগুলোর সামনে। এবং বিদ্যুৎমন্ত্রীকে সেখান থেকেই ফোনে সমস্যা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কিছু একটা করা হোক’’। তখনও সবাই তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আগেও অনেকে এসেছেন। কেউ কথা রাখেনি।’’ কিন্তু এবার যে ‘যেমন কথা তেমন কাজ’ হবে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন কয়েকদিনেই।বিদ্যুৎমন্ত্রীকে ‘সেই কিছু একটা করতে বলা’ মানে যে বিদ্যুতের গতিতে সমীক্ষা সেরে, নানা জট কাটিয়ে কাজ সেরে ফেলা, তা সত্যি কি না ভাবতেও যেন গায়ে চিমটি কাটার অবস্থা মানুষগুলোর। কাজ শেষ মাত্র সাতাশ দিনেই! রবিবার গ্রাম যখন উৎসবের মেজাজে তখনও বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপবাবু সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে কি না খোঁজ নিলেন কুণালবাবুকে ফোন করে।
রাত পর্যন্ত গ্রামে থাকা তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণালবাবুর সঙ্গে প্রাক্তন পুর চেয়ারম্যান দেবপ্রসাদ মণ্ডলও তদারকি করলেন, যাতে কোনও সমস্যা না হয়। হয়ওনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার চেষ্টা করেছে, আইন দেখিয়ে যাতে কাজ আটকানো যায়। কাজ চলাকালীন বাধা দিতে পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। লাভ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, আলো, জলের মতো জীবনযাপনের আবশ্যিক সুবিধা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না, সেই বিষয়টি সামনে রেখেই কাজ হয়েছে এবং শেষও হয়েছে রেকর্ড সময়ে।
এতদিন ভোট এলেই তো প্রতিশ্রুতি পেতে অভ্যস্ত ছিলেন ওই দু’টি গ্রামের মানুষ। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। বর্তমান বিজেপি নেতা, একদা সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও (Suvendu Adhikari) ২০১২ সালে গ্রামবাসীদের সাদা কাগজ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই তো বিদ্যুৎ এল বলে।’ সেই কাগজ ভেসে গিয়েছে হলদি নদীর জলে। বারবার বাম নেতারাও কথা দিয়েছিলেন যেন কথা রাখবেন না বলেই, ভোট রাজনীতির লক্ষ্যে।
কুণালবাবুও শুভেন্দুকে বিঁধে বলেছেন, ‘‘উনি কথা দিলেও কথা রাখেননি। দিব্যেন্দু অধিকারী সাংসদ। কিন্তু কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিথ্যাচার করে গিয়েছেন। উলটে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে এবার আমাদের কাজে বাধা দিয়েছেন। মানুষ বুঝে নিয়েছেন কারা প্রকৃত কথা রাখতে সক্ষম। একটা নতুন ইতিহাস রচিত হল। এই ঘটনার সাথী হতে পেরে আমি গর্বিত। এর জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে (Arup Biswas) ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বিদ্যুৎ দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মীদের।’’ এই ক’দিনে ২২টি ট্রান্সফরমার বসানো হয়েছে। বসেছে ৩৫০টি বিদ্যুতের খুঁটিও। খরচ হয়েছে ৬ কোটি টাকা। প্রতীকীভাবে একটি বাড়িতে আলো জ্বলেছে। ৫৫টি বাড়িতে পরিকাঠামোগত কাজ শেষ হলেই সংযোগ মিলবে। প্রথম বাড়িতে সুইচ টিপেই কুণালবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন মহিলা। উচ্ছ্বাস। স্বপ্নপূরণের রাতেই অন্য ‘সূর্যোদয়’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.