কলহার মুখোপাধ্যায় ও মনিরুল ইসলাম: নিজের অসুস্থতা লুকাবেন না। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে করোনা সারবেই। আমিই তার উদাহরণ। প্রায় এক মাস COVID-19 নামের মারণ ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের পর এমনই প্রতিক্রিয়া বিজয়ীর। শনিবার দমদম নাগেরবাজারের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে আসার পর তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া এটাই।
করোনা যোদ্ধা পরেশ ঘোষ পেশায় ব্যবসায়ী। থাকেন খড়দা মধ্যপাড়ায়। ২৬ মার্চ জ্বর এবং কাশি নিয়ে ভরতি হন নাগেরবাজারের বেসরকারি হাসপাতালে। শরীরে করোনা উপসর্গের লক্ষ্মণ থাকায় তাঁকে আইসোলেশনে রাখা হয়। মোট ৬ বার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রথম চারবার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। কিন্তু দমে যাননি তিনি। হালও ছাড়েননি। বুকে পেসমেকার, গলব্লাডার অপারেশন হয়ে গিয়েছে। এ বাদ দিয়ে অসুস্থতা নেই।
কিন্তু হঠাৎ করে করোনা তাঁকে শুইয়ে দিয়েছিল। হাসপাতালের নিভৃত কক্ষে একাকী প্রায়একটা মাস কেটেছে তাঁর। পরেশবাবু জানিয়েছেন, ২৪ মার্চ জ্বর এসেছিল, তাই হাসপাতালেই ভরতি হয়ে যান। ৩১ তারিখ জ্বর কমে যায়। কাশিও গায়েব দিন দুই পর। তবে করোনা পরীক্ষা তখনও বাকি। ৩১ তারিখই সোয়াব টেস্টে পাঠানো হয়। ১ তারিখ রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এক সপ্তাহ বাদে আবার পজিটিভ রিপোর্ট। তারপর দু’বার রিপোর্ট। তবে ভয় পেয়ে যাননি পরেশ ঘোষ। কারণ, এই রোগ যন্ত্রণাদায়ক নয়। চিকিৎসকদের অভয়বাণীও তাঁর মনে জোর দিয়েছে। তাই তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে একদিন রিপোর্ট নেগেটিভ হবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সেই সুদিন এল। চিকিৎসক জানালেন, ভয়ের কিছু নেই, পঞ্চম রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। ষষ্ঠ রিপোর্ট দু’দিনের মাথায়, তাও নেগেটিভ। এরপর শনিবার করোনা যুদ্ধ জয়ে করে বাড়ি ফেরা। আজকের আপৎকালীন পরিস্থিতিতে পরেশবাবু অনুরোধের সুরে সবাইকে বলেছেন, ”অসুস্থ বোধ করলে, সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যান। করোনা এমন কিছু হাতি-ঘোড়া রোগ নয়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু হলে ভয়ের কোনও বিষয় নেই।”
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, নিভৃতবাসে পরেশবাবু ও অন্যান্য সংক্রমিত রোগীদের জন্য পুরোপুরি আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। চোখ থেকে পা পর্যন্ত নিখুঁত আবরণে ঢেকে চিকিৎসা চালান চিকিৎসক, দেখভাল করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। হাসপাতালের সিইও নিবেদিতা চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ”শরীর খারাপ না লুকিয়ে দয়া করে চিকিৎসা করান। তাহলে করোনা আটকাতে বিশেষ সময় লাগবে না।” দক্ষিণ দমদমের পুরপ্রধান পাঁচু রায়েরও একই বার্তা – অসুস্থ বোধ করলে পুরসভাকে জানালে চটজলদি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শরীর খারাপ লুকিয়ে নিজের এবং সমাজের বিপদ ডেকে আনবেন না।
এ তো গেল এক যোদ্ধার কথা। শনিবার বিকেলে বাড়ি ফিরলেন আরও এক করোনা যোদ্ধা। হাওড়ার বাগনান-শ্যামপুর রোড দিয়ে তিনি বাড়ি ফেরার সময়ে দেখা গেল, সহড়া গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, আশা কর্মী ও আরও অনেকে। সংখ্যাটা জনা ২০ হবে। আপাতদৃষ্টিতে কোনও ভিআইপির জন্য এই আয়োজন হয়ে থাকে। যিনি এলেন তিনিও ভিআইপি। তবে একটু অন্যরকম। দেখা গেল, অ্যাম্বুলান্স থেকে নামলেন বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা। কাছাকাছি আসতেই বাগনান দু’নম্বর ব্লক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ইনচার্জ ডাক্তার বিনয় রায়-সহ সকলেই উচ্ছ্বাসে করতালি দিয়ে উঠলেন।
প্রৌঢ়া দিন পনেরো আগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার এমআর বাঙুর হাসপাতালে ভরতি ছিলেন। সুস্থ হয়ে শনিবার তিনি বাড়ি ফিরলেন। বাড়ির সামনে এত জনসমাগম দেখে আনন্দে হঠাৎই তাঁর চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল, ঠোঁটে মৃদু হাসি। এই প্রৌঢ়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে ব্লক স্বাস্থ্য দপ্তর তাঁকে অভিনন্দন জানোনোর পরিকল্পনা করেছিল। সেই অনুযায়ী এই ব্যবস্থা। আপাতত ১৪ দিন তিনি থাকবেন হোম কোয়ারেন্টাইনে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.