সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দশ বাই পনেরো ফুটের একটি ঘর। ছাউনি এসবেসটাসের। ঘরের চার দেওয়াল পেপার আর রঙিন কাগজ দিয়ে আটকানো। তিনটে ছোট ছোট জানালা থাকলেও তার শিক ভাঙাচোরা। মেঝেও অমসৃণ। প্রবেশ পথের মূল দরজা বাঁশের। সেখানেই চলতো পাঠচক্র। যা আদতে কোচিং সেন্টারের মত। এলাকায় নাম সুভাষ পাঠচক্র। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির অযোধ্যা পাহাড়তলির তুনতুড়ি গ্রামে এই পাঠচক্রের না আছে কোন সাইনবোর্ড বা ব্যানার। তবুও প্রায় খাতায়-কলমে ৪৫ জন পড়ুয়া। যা ‘সাম্যবাদী সুভাষ সভা’-র ব্যানারে চলতো। যে এনজিওকে নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর তোলপাড় হয়েছে। আসলে এই এনজিও তথা ওই পাঠচক্রের সঙ্গে যে সংসদ হামলার মূলচক্রী শিক্ষক ললিত ঝা-র যোগ! সামাজিক মাধ্যমে ললিতের বন্ধু ওই ‘সাম্যবাদী সুভাষ’-র কর্ণধার নীলাক্ষ আইচ।
চাঞ্চল্যকর তথ্য লক্ষ্মীবারের বিকালে পুরুলিয়া জেলা পুলিশের কাছে প্রাথমিকভাবে আসতেই শিউরে উঠেছে অযোধ্যা পাহাড়তলির এই জনপদ। আসলে যার উদ্যোগে এই পাঠচক্র সেই ‘সাম্যবাদী সুভাষ সভা’র রাজ্য সভাপতি তথা কর্ণধার নীলাক্ষ আইচকে কখনও দেখেনি এই কোচিং সেন্টারের শিক্ষক থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা। দেখেনি এই অজপাড়া গাঁ। উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহরের নীলাক্ষ যে এই তুনতুড়িতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকা দেব বিশ্বপতি কুইরির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেই এই কোচিং সেন্টার চালু করিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় নীলাক্ষ তাকে ‘সাম্যবাদী সুভাষ সভা’-র জেলা সভাপতিও করে দেন। যা ধরা পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। যা এখন রীতিমতো ভাইরাল।
তাই ওই এনজিওকে নিয়ে শোরগোল বাঁধতেই পরিবেশ ও বন্যপ্রেমী, সর্পবন্ধু দেব বিশ্বপতির খোঁজ মিলছে না। দুপুরের পর থেকেই তার মোবাইল বন্ধ। এদিন রাতে তুনতুড়ির কুইরিপাড়ায় তার বাড়িতে গেলে দেখা যায় কুঁড়ে ঘরে লোহার দরজায় তালা ঝুলছে। জেলা পুলিশের কাছে ললিত যোগের খবর আসতেই বাঘমুন্ডি থানা ও সুইসা ফাঁড়ির পুলিশ এই এলাকা ঘুরে যায় বিকালেই। আর তারপর থেকেই কালিমাটি- সুইসা রাস্তা থেকে ডানদিকে ১০০ মিটার দূরে ওই পাঠচক্র লাগোয়া এলাকা একেবারে থমথমে। রাত আটটা নাগাদ সেখানে গিয়ে দেখা যায় একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পথবাতির আলোও জ্বলছে না। ওই পাঠচক্রের একটিমাত্র ঘরের প্রবেশপথের বাঁশের দরজা খুলতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসেন এলাকার বাসিন্দারা। কিছুটা দূরে ঘর থেকে বার হন মহিলারাও। কারও মুখেই কোন কথা নেই।
সেখানে থাকা তথা এলাকার বাসিন্দা, এই স্কুলের শিক্ষক অভিজিৎ কুইরি বলেন , “কি হয়েছে বলুন তো ? আমাদের পাঠচক্রের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বারবার করে জিজ্ঞাসা করছে। পুলিশ এসে ঘুরে গেল। আমরা তো দরিদ্র শিশু, ছোট-ছোট ছেলে মেয়েদের পাঠদান করে থাকি। যারা দারিদ্রতার কারণে টিউটর পায় না তাদেরকেই আমরা পাঠ দিই। আমাদের গ্রামের দাদা বিশ্বপতির কথায় আমি এখানে শিক্ষকের কাজ করছি। যিনি এই স্কুল করেছেন উত্তর ২৪ পরগনার নীলাক্ষবাবু তার সঙ্গে আমার একবারই মাত্র কথা হয়েছিল।”
এই এলাকার মোট পাঁচজন বেকার ছেলে এই পাঠচক্রের শিক্ষক। তারা অবশ্য কোন বেতন বা সাম্মানিক পান না। চলতি বছরের অক্টোবরের ২৯ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই পাঠচক্র ফি সপ্তাহে মঙ্গল, শুক্র ও রবিবার পাঠদান করা হয়। অন্যান্য দিন সময়- সুযোগ থাকলে সেদিনও এই কোচিং সেন্টার খোলা থাকে। এই পাঠচক্রের আরেক শিক্ষক, এই তুনতুড়ি গ্রামের বাসিন্দা দেববীরবল কুইরি বলেন, ” বিকাল থেকে যা সব শুনছি তা শুনে শিউরে উঠেছি। আমরা তো অতশত কিছু বুঝি না। আমাদেরকে বলা হয়েছিল দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করতে। আমরা বেকার ছেলে ঘরে বসে থাকি। তাই এই পাঠচক্রে এসে ছেলে-মেয়েদেরকে পড়ায়। যতটুকু জানি ততটুকু শেখায়। সেটাই ভালো লাগে। এই পাঠচক্রের সঙ্গে কোথায় কি যোগ রয়েছে সেসব বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই।”
জানা নেই অযোধ্যা পাহাড়তলির এই জনপদ তুনতুড়ির। কিন্তু প্রশ্ন হাজারও! আর সেই প্রশ্ন থেকেই নীলাক্ষ আইচ-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ” আমাকে কোন তথ্য দিতে পুলিশ থেকে বারণ করা হয়েছে। আমি কিছু বলতে পারব না।” এই স্কুল তথা ওই সমাজসেবী সংগঠনের সভাপতি নীলাক্ষ এখন এড়িয়ে যেতে চাইলেও পাঠচক্রের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা-মা তথা অভিভাবকদের মন এখন অজানা আশঙ্কায় দুলছে।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.