ব্র্রতীন দাস
–‘এ-ই টোটো এদিকে যাবি’?
–‘এ-ই টোটো ওদিকে যাবি’?
রাস্তায় বেরলে হামেশাই এরকম ‘তুই-তোকারি’ ডাক শুনতে পাওয়া যায়৷ সওয়ারি হতে অনেকেই এভাবে ডেকে থাকেন ব্যাটারিচালিত রিকশাকে৷
কিন্তু, একবারও ভেবে দেখেছেন কি এই ডাকে প্রতিমুহূর্তে ধাক্কা খাচ্ছে এক বিলুপ্তপ্রায় জনগোষ্ঠীর জাত্যাভিমান!
হয়তো ভাবেননি৷ কিন্তু সেই জাত্যাভিমানকে পুঁজি করেই প্রতিবাদে সরব হয়েছে ডুয়ার্সের অতি প্রাচীন ক্ষুদ্রতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী, টোটো সম্প্রদায়৷
কখনও পাড়ার গলিরাস্তা থেকে হাই রোডে উঠে পড়া৷ কখনও আবার ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে যানজট বাড়িয়ে তোলার মতো অভিযোগ ছিল এতদিন৷ কিন্তু এবার ‘টোটো’-র বিরুদ্ধে এ-এক অন্য অভিযোগ৷ বিষয়টি জেলাশাসকের দফতর পর্যন্ত গড়িয়েছে৷ দাবি উঠেছে, টোটো রিকশার নাম পরিবর্তনের৷ প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখেই প্রয়োজনে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, বলছেন টোটো কল্যাণ সমিতির সম্পাদক৷
হাউরি, বাংরি, তিতি–ডুয়ার্সে সাত পাহাড়ি নদী পেরিয়ে পৌঁছতে হয় টোটো পাড়ায়৷ মাদারিহাট থেকে একুশ কিলোমিটার দূরে তাদিং পাহাড়ের উপর ভুটানের কোলে টোটোদের বাস৷ সাকুল্যে হাজার দেড়েক বাসিন্দা৷ সাড়ে তিনশোর মতো পরিবার৷ তাঁদের অভিযোগ, “শহর-গঞ্জে গেলে দেখি, জাতির নামে রিকশা চলছে৷ আর সেই রিকশাকে নানাভাবে ডেকে হাসি-ঠাট্টা করা হচ্ছে৷ সেসব শুনে খুবই অপমানকর মনে হয়৷ যেন ‘টোটো’ নামের বে-ইজ্জতি হচ্ছে৷”
বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে৷ কিন্তু আর মুখ বুজে সেই ‘অপমান’ সইতে নারাজ টোটোরা৷ ব্যাটারিচালিত ‘টোটো’ রিকশার নাম বদলানোর দাবি আদায়ে শুরু হয়েছে স্বাক্ষর সংগ্রহ৷ টোটো কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বকুল টোটো-র প্রশ্ন, “টোটো নামে যেখানে একটি জাতি রয়েছে, সেখানে ওই নামে রিকশা-র নামকরণ হল কীভাবে? প্রশাসনই বা নীরব কেন?” বলেছেন, “বিষয়টি নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে নালিশ জানিয়েছে৷ এর পর প্রশাসন কী করে তা দেখব আমরা৷ তার পর তো আইন রয়েইছে৷”
ডুয়ার্সে মঙ্গোলিয়ান বংশোদ্ভূত টোটোদের বাস সাত-আট পুরুষ৷ একসময় তাঁদের একমাত্র জীবিকা বলতে ছিল ঝুম চাষ৷ এখন বেশিরভাগই ভুটানে শ্রমিকের কাজ করেন৷ একসময় টোটোদের জনসংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছিল৷ রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে সরকারি সহায়তা পৌঁছতে শুরু করে টোটো পাড়ায়৷ তাঁদের জীবন-যাপনের মান বাড়াতে নেওয়া হয় উদ্যোগ৷ মিলছে দু’টাকা কেজি দরে চাল-আটা৷ পৌঁছেছে পানীয় জল, বিদ্যুৎ৷ বাড়ছে শিক্ষার হার৷
এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন টোটোরা৷ তাঁদের বক্তব্য, জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে সরকার বাহাদুর যেখানে এতসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে এ কেমন উপহাস! জাত্যাভিমানকে মর্যাদা দিতে কেনই বা বদল হবে না রিকশার নাম?
আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম বলেছেন, “টোটোদের তরফে এখনও কোনও দাবিপত্র পাইনি৷ তবে তেমন কিছু পেলে রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে তা পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷” জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মুক্তা আর্য বিষয়টি জানা নেই বললেও তাঁর বক্তব্য, “যদি কারও ভাবাবেগে আঘাত লাগে তবে তা ভেবে দেখা দরকার৷” রাজ্যের আদিবাসী উন্নয়নমন্ত্রী জেমস কুজুর অবশ্য বলেছেন, “রিকশার নামের সঙ্গে কোনও জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক নেই৷ তবে এনিয়ে টোটোদের পক্ষ থেকে কোনও বক্তব্য থাকলে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখা হবে৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.