রঞ্জন মহাপাত্র, কাঁথি: কাঁথি লোকসভা হারায় কাজিয়া তৃণমূলে। অভিযোগ-পালটা অভিযোগে জেরবার কাঁথি সাংগঠনিক জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। শাসক শিবিরের প্রার্থী উত্তম বারিক ঘুরিয়ে তোপ দেখেছেন ‘কিছু বর্ষীয়ান’ নেতার দিকে। দলের মধ্যে আলোচনা চলছে, উত্তম-তিরে বিদ্ধ রামনগরের বিধায়ক, মন্ত্রী অখিল গিরি। সেই তালিকায় আছেন জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ তরুণ জানা। আর অখিলবাবু ও তাঁর পুত্র, পুরচেয়ারম্যান সুপ্রকাশ গিরি এই হারের জন্য প্রচার কৌশল ও উত্তমবাবুর নিজের মতো করে সবকিছু করার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কি না তা দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন। শুধু তাই নয়,৬ টি বিধানসভায় বিজেপি লিড পেলেও উত্তমবাবুর বিধানসভা পটাশপুরে কোন সমঝোতায় তিনি লিড পেলেন তাও ভাবা উচিত দলের, বলে কটাক্ষ করেছেন।
কাঁথিতে তৃণমূলের প্রার্থী পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা পটাশপুরের বিধায়ক উত্তম বারিককে হারিয়ে জিতেছেন শুভেন্দু অধিকারীর ভাই, প্রাক্তন পুরচেয়ারম্যান সৌমেন্দু অধিকারী। ফলাফলে দেখা যায়, ৭টি বিধানসভার মধ্যে পটাশপুর ছাড়া চণ্ডীপুর, খেজুরি, ভগবানপুর, উত্তর কাঁথি, দক্ষিণ কাঁথি, রামনগর বিধানসভায় পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল। যদিও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভগবানপুর, খেজুরি, উত্তর কাঁথি এবং দক্ষিণ কাঁথি বিজেপি দখল করেছিল। ফলে লোকসভা ভোটে জয়ী হতে হলে তৃণমূলের পাখির চোখ ছিল চণ্ডীপুর, রামনগর, পটাশপুর। এই তিনটি বিধানসভায় মার্জিন বাড়ানোর পাশাপাশি বিজেপির দখলে থাকা বিধানসভা এলাকায় বিজেপির মার্জিন কমানো। ফলে তৃণমূলের জয় নিশ্চিত। সেইমতো খেজুরি, ভগবানপুরে বিজেপির ঘর ভাঙতে শুরু করে তৃণমূল।
কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পরে দেখা যায়, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভগবানপুরে বিজেপির যেখানে ব্যবধান ছিল ২৭ হাজার ৫৪৯, সেখানে লোকসভায় মার্জিন কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮৫তে। কিন্তু চণ্ডীপুর বিধানসভায় যেখানে তৃণমূলের মার্জিন বাড়ার কথা সেখানে সেখানে বিজেপি ৮৪২ ভোটের ব্যবধান বাড়িয়েছে। পাশাপাশি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রামনগর বিধানসভা থেকে অখিল গিরি ১২ হাজার ৫১৭ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। সেখানে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৯ হাজার ১৬৮ ভোটে এগিয়ে গিয়েছে। কাঁথি পুরসভা এলাকায়ও পিছিয়ে তৃণমূল। এমনকী, মন্ত্রীর নিজের বুথ ও চেয়ারম্যানের নিজের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডেও তৃণমূল পরাজিত। ফলে রাজ্যের সংশোধনাগার মন্ত্রী অখিল গিরি ও কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান সুপ্রকাশ গিরির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল কর্মীরা।
এমনকী, উত্তর কাঁথিতে বিজেপি ৭০৯৯ ভোটে এগিয়ে রয়েছে। উত্তর কাঁথির কো-অর্ডিনেটর তথা জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ তরুণ জানার নিজের ২৪৯ নম্বর বুথ মুকুন্দপুর ভূপেন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৫৮ ভোটে পিছিয়ে দল। ফলে তরুণ জানার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল কর্মীরা। এদিকে, পটাশপুর বিধানসভা এলাকায় ৮৬০৮ ভোটে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও কাঁথি সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি পীযূষকান্তি পণ্ডার পটাশপুর এক নম্বর ব্লকের মকরামপুর নীলকন্ঠ শিক্ষা সদনের ২১৯ নম্বর বুথে মাত্র ১টি ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। ফলে জেলা সভাপতি নিজের বুথেও পরাজিত হয়েছে দল। ফলে তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে এখন সরগরম হয়ে উঠেছে কাঁথির তৃণমূল নেতৃত্ব।
কাঁথি লোকসভার তৃণমূল প্রার্থী উত্তম বারিক বলেন, ‘‘আমার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। তবে চণ্ডীপুর ও রামনগর বিধানসভা যেটা তৃণমূলের হাতে ছিল। সেখানে কেন এতটা খারাপ ফল তা নিশ্চয় খতিয়ে দেখবে দল। অন্তর্ঘাত আছে। তা না হলে কাঁথি লোকসভার পটাশপুর বাদ দিয়ে ছটি বিধানসভায় কেন পিছিয়ে গেলাম? ভগবানপুরে যেখানে ২৭ হাজার ভোটের মার্জিন কমানো গেল, সেখানে কেন আমাদের হাতে থাকা বিধানসভায় এই হাল তার কারণ নিশ্চয়ই দল খুঁজে বের করবে। আর মন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই। রামনগরের তৃণমূল কর্মীরা সোশাল মিডিয়ায় লেখালেখি করছেন। সেটাই আমি বলেছি।’’
সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের কর্মীরা দলের নেতাদের বড় অংশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানে মন্ত্রী অখিলবাবু ও তাঁর ছেলে সুপ্রকাশবাবুর দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। মন্ত্রী অখিল গিরি বলেন, ‘‘কাঁথি লোকসভায় শুধু রামনগর বিধানসভা পড়ে না। একটি বিধানসভা বাদ দিয়ে সব জায়গায় ভোট কমেছে। এর পিছনে কী কারণ আছে তা আমাদের সকলকে বসে খুঁজে বার করতে হবে। এই পরাজয় আমার অত্যন্ত খারাপ লাগার। তবে আমরা আমাদের মত কাজ করেছি। আমার এলাকায় এমন ফল কোনওদিন হয়নি। তবে এটা সার্বিক বিপর্যয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলাজুড়ে হয়েছে। তবে কেউ কেউ নিজেদের ব্যর্থতা অন্যের উপর চাপাতে চাইছেন। যারা দায় চাপায় তারা নিজেরা কোন কাজ করে না।’’
তবে মন্ত্রী পুত্র সুপ্রকাশ গিরি নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, ‘‘এখন মন্ত্রীর কথা মনে পড়ছে। যখন নির্বাচন কমিটি তৈরি হয়েছিল তখন কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন জেলা সভাপতি। বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তি অখিল গিরিকে শুধুমাত্র সদস্য করা হয়েছিল। মন্ত্রীকে না জানিয়ে রামনগর এলাকার ২০২১ সালের বিজেপি প্রার্থীর বাড়িতে তৃণমূল প্রার্থী হাজির হয়েছিলেন। মন্ত্রীকে আড়ালে রেখে রামনগর বিধানসভার নির্বাচনী কমিটি তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনী কমিটিকে বাদ দিয়ে প্রার্থী নিজে প্যারালাল কমিটি করে প্রচার করেছেন। এক-দুই অঞ্চল ছাড়া কোনও অঞ্চল সভাতে প্রার্থী হাজির হননি। মন্ত্রী নিজে সভা করেছেন। আর প্রার্থী আলাদা সভা করেছেন। রামনগরের বিধায়ক তথা মন্ত্রীকে আড়ালে রেখে কাজ করতে গিয়ে এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাস নষ্ট করা হয়েছে। রামনগরের পরাজয়ের দায় নাকি আমাদের। তাহলে খেজুরিতে প্রার্থী নিজে দায়িত্বে ছিলেন। নিজের জেলা পরিষদ আসনে ২ হাজার ভোটে পিছিয়ে কেন আছেন। তার দায় কার। তাছাড়া পটাশপুর ছাড়া বাকি সব বিধানসভায় পরাজয়ের কারণ খুঁজতে আগে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নিজের বিধানসভাকে বাঁচানোর জন্যে কোনও সমঝোতা হয়েছে কী না তাও দেখতে হবে। তাছাড়া কাঁথি পুরসভায় আমি দুই মাস আগে বসেছি। ঠিক মতো গুছিয়ে উঠতে পারা যায়নি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ১৬টি বিধানসভার মধ্যে ১৫টিতে তৃণমূলের পরাজয়ের দায় সভাধিপতি হিসেবে নিজেকে নিতে হবে। কেন এমন ভরাডুবি হয়েছে। এর পিছনে সমঝোতা থাকতে পারে বলেও তো অভিযোগ উঠছে। তাই পরাজয় নিয়ে অন্যের উপর দায় চাপানো বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হবে।’’
কাঁথি সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান তরুণকুমার মাইতি বলেন, ‘‘কোনও ব্যক্তি একটা বা দুটো বিধানসভায় মার্জিন কমাতে পারে। কিন্তু জেলায় ১৫টি বিধানসভায় ভরাডুবির কারণ খুঁজে বার করতে হবে। কারও উপর দায় চাপিয়ে সরে গেলে চলবে না। আমরা বসে এই পরাজয় কারণ খুঁজে বের করার নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.