পলাশ পাত্র, তেহট্ট: কয়েকদিন আগেই পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নশ্বর দেহ। কিন্তু মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মিকযোগের সূত্র কতটা মজবুত ছিল, তা মর্মে মর্মে অনুভব করছেন দেশবাসী। স্মৃতি হাতড়ে নদিয়ার তেহট্টও খুঁজছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ছেড়ে যাওয়া মুহূর্ত। ওঁরা চূর্ণীলাল দত্ত, শংকরীপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও জয়দীপ বোস। এঁদের প্রথম দু’জনে আজ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছালেও তৃতীয়জন মাঝবয়সী। ১৯৯৯-র ২৮ সেপ্টেম্বর দিনটা তাঁরা ভুলতেই পারেন না। ওইদিন কৃষ্ণনগর সার্কিট হাউসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর পদধূলি পড়েছিল। সেই সার্কিট হাউসে তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন এই তিনজন। শংকরীপ্রসাদ ভট্টাচার্য আকাশবাণীর নদিয়া জেলার সাংবাদিক, সেই সময় বিজেপির অনুগত সৈনিক চূর্ণীলাল দত্ত। বিজেপির যুবমোর্চার নেতা জয়দীপ বোস। ১৯ বছর আগের সেই দিনটিতে খুব কাছ থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁদের। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে সেদিনের স্মৃতিচারণে এই তিনজন। হাতে কেন্দ্রের উন্নয়ন বার্তার প্রেস রিলিজ। যেটি বাজপেয়ী নিজে হাতে তাঁদের দিয়েছিলেন। আমজনতার কাছে কেমন ছিল তাঁর আচরণ? জেনে নিই এঁদের কাছে।
১৯ বছরে অনেক বদল এসেছে। শংকরীপ্রসাদ ভট্টাচার্য পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নদিয়াতে দু’বার এসেছেন বাজপেয়ী। একবার বিজেপি নেতা হিসেবে। আর একবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ১৯৯৯ সালে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হেলিকপ্টারে চড়ে ঘুরে দেখেন নদিয়া মুর্শিদাবাদের উপদ্রুত এলাকা। তারপর সভা শেষে পৌঁছান কৃষ্ণনগর সার্কিট হাউসে। জেলার সাংবাদিকরা তখন প্রধামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে উদগ্রীব। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না। সেই সময় জেলায় প্রধামন্ত্রীর মিডিয়া পার্সনের দায়িত্বে থাকা জুলুবাবু নিজে সাংবাদিক সম্মেলনের ব্যবস্থা করে দেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিনিধি দল এসেছিল। সেই দলে ছিলেন দেশের নামী সাংবাদিকরাও। তবে কথা বলার সময় জেলার সাংবাদিকদেরও গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমাদের থেকে অনেক কিছুই জেনে নেন। সেই সময় জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী। বামফ্রন্ট পরিচালিত রাজ্য সরকারের দাবি ছিল, বন্যা পরিস্থিতির জন্য তেমনভাবে কোনও সাহায্যই করছে না কেন্দ্রীয় সরকার। একথা শোনার পর কোনও রকম উষ্মা প্রকাশ না করেই সাংবাদিকদের হাতে প্রেস রিলিজ ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যাতে কেন্দ্রের দেওয়া আর্থিক বরাদ্দে পরিমাণ। সঙ্গে কোথায়, কোন খাতে কত খরচ করা হচ্ছে তার হিসেব। সংগ্রহে থাকা সেই প্রেস রিলিজ আজ স্মৃতিচারণের অন্যতম নথি। ৯৬-তে যখন দলীয় প্রচারে কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন জ্যোতি বসু সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ব্যক্তিগত আক্রমণে সায় ছিল না তাঁর। তাই স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে গিয়েছেন প্রসঙ্গ। বলেছিলেন, “জ্যোতি বসু আমার বন্ধু। তাঁর সম্পর্কে কিছুই বলব না”।’
দলীয়কর্মী হওয়ার সুবাদে বহুবার বাজপেয়ীকে দেখার সুযোগ হয়েছে চূর্ণীলাল দত্তের। তবে ৯৯-র ২৮ সেপ্টেম্বর দিনটি বিশেষ পাওনা হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। চূর্ণীলালবাবু বলেন, ‘আমি ওঁর সঙ্গে জনতা দল করেছি। এমনকী, ১৯৮০ সালে বিজেপির প্রতিষ্ঠা থেকেই ওনার সঙ্গে দল করেছি। দিল্লি-সহ বিভিন্ন রাজ্যে ন্যাশনাল কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ সদস্য হওয়ার কারণে তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। সম্ভবত ১৯৯৮-তে দিল্লিতে স্লোগান চলছে, “প্রধানমন্ত্রী আগলিবারি/ অটলবিহারী অটলবিহারী।” সেই সময় ওনাকে বলেছিলাম আপনিই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। উনি বললেন, “কটা এমপি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে? আগে জেতাতে হবে তো।” সেদিনের সেই কথাগুলো আজও যেন শুনতে পাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেসব বড় বেশি করে মনে পড়ছে। সেদিন কৃষ্ণনগরের সার্কিটহাউসে আমাকে জুলুবাবুর প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। আমিও সেই দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তাই আলাদা পাওনা তো বটে। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ আমাকে টেনেছিল। তাই ২০০৭-এ বিজেপি ছেড়ে দিই। একইসঙ্গে অটলজি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিজেপির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছিলাম। দেখেছিলাম বিজেপি কীভাবে সিপিএমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। তবে একথা ঠিক যদি বাজপেয়ী রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতেন তাহলে বিজেপি ছাড়তাম না। ওঁর প্রতি আমরা একটা আসক্তি ছিল। খুব বড় নেতা ছিলেন। সবাইকে নিয়ে চলতে পারতেন।’
প্রধানমন্ত্রী সার্কিট হাউসে এসে খাবেন। সেই খাবারের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমানে বিজেপির জেলা সহ-সভাপতি জয়দীপ বোস তিনি বলেন, ‘অটলজি মাঠে মিটিং সেরে এসে চুপচাপ ঘরে বসেছিলেন। চোখ মুখে ক্লান্তিহীন বিনয়ের ছাপ স্পষ্ট। এতবড় নেতাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। তাঁর জন্য অনেক খাবারের আয়োজন হয়েছিল। তারমধ্যে থেকে একটা রুটি, সামান্য দুটো সরপুরিয়া আর এককুচি শসা খেয়েছিলেন। তার কিছু সময় পরই দিল্লির উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.