বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না, ভরসা ছিল মায়ের কোল। কিন্তু তাই-ই বা কদিন? নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের নিতান্ত গরিব পরিবারের ছেলে সামিন শেখকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করানোর খুব একটা তাগিদ ছিল না মা, বাবার। বাধ্য হয়েই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে কাজে বেরিয়ে যেতেন সামিনের মা মরজিনা বিবি।
নদিয়া জেলার সমগ্র শিক্ষা অভিযানের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সামিনের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হল হুইলচেয়ার। সামিনের জীবনে এল গতি। আর পাঁচজনের মতোই এগিয়ে চলার পথ পেল সে। এবার থেকে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কিশোরকে আর বাড়িতে বসে থাকতে হবে না। অনায়াসে সে হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে স্কুলে যেতে পারবে। মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারবে অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।সামিনের মা মরজিনা বিবির কথায়, ‘এবার থেকে আমি আমার ছেলেকে ওই চেয়ারে বসিয়ে যে কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। পৌঁছে দিতে পারব স্কুলেও।’
কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক প্রশাসনের কর্তারা আরও খানিকটা এগিয়ে এসেছেন সামিনের পরিবারের কথা ভেবে। তাঁরা জানিয়েছেন, সামিনদের টিনের চালের ঘরটা পাকা করে দেওয়া হবে এবার। কিন্তু এমনটা ছিল না এর আগে। ষোল বছর বয়সী সামিন একা স্কুলে যেতে পারত না। শিবনিবাস শ্রী শ্রী মোহনানন্দ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সামিন তাই দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে অনুপস্থিত থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। হয়ত স্কুলের রেজিস্ট্রার খাতা থেকে তার নামটা বাদই দেওয়া হত।
শিক্ষক দিবসের আগের দিন অভিভাবকদের মিটিংয়ে ওই স্কুলের ক্লাস টিচার সবিতা হাজরা বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি আরও জানতে পারেন, কেন সামিন দীর্ঘদিন স্কুলে আসতে পারে না।এরপরই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, শিক্ষক দিবসে সামিনের বাড়ি গিয়ে তাকে দেখে আসবেন। সেইমতো গিয়েওছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। দেখেছিলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সামিনকে বাড়িতে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই দড়ির বাঁধন খুলে সামিনকে তাঁরা মুক্ত করেছিলেন। হাতে তুলে দিয়েছিলেন ফুল,মিষ্টি-সহ সামান্য উপহার। এভাবেই অন্যরকম শিক্ষক দিবস পালন করেছিলেন শ্রী শ্রী মোহনানন্দ হাইস্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকারা।
সেদিনই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সামিনকে আবার শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা হবে। তাকে একটি হুইল চেয়ার দেওয়ার কথা ভাবেন। সকলে মিলে ঠিক করেন, বাড়ি গিয়ে পালা করে সামিনকে পড়িয়ে আসবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সামিনকে তার বাড়িতে গিয়ে পড়িয়েছেন ওই স্কুলের শিক্ষিকা সবিতা হাজরা। তিনি বলছেন, ‘সামিনকে পড়িয়ে,লিখিয়ে খুবই ভালো লাগল। একটা অন্যরকম অনুভূতি হল আমার।’ সমগ্র শিক্ষা অভিযানের স্পেশ্যাল এডুকেটর সীমা সরকার নিজেও গিয়েছিলেন সামিনের বাড়িতে। নতুন হুইলচেয়ারে তাকে যত্ন করে বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,’আগামী দিনে সরকারি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পাবে সামিন।’
এতদিনের একটা গতানুগতিক জীবন, হাজারও বাধা পেরিয়ে হুইলচেয়ারকে নতুন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যেন খুশির বাঁধ ভেঙে গিয়েছে সামিনের তার চোখেমুখে সেই রেশ।এদিন সামিনকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে তার বাবা গিয়েছিলেন শিবনিবাসের শিবমন্দির দেখাতে। হুইলচেয়ারে বসেই বহু দিন পর সামিন দেখেছে প্রকৃতি আর বাইরের চেনা, অচেনা অনেক মুখ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ‘শিবমন্দিরে গিয়ে সামিন একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল।’ হয়ত এভাবে চেষ্টা করতে করতেই একদিন উঠে দাঁড়াবে সামিন শেখ। তাকে দেখে প্রতিবন্ধকতা জয়ের পাঠ নেবে আরও অনেকে। আর সেখানেই সার্থক হয়ে উঠবে আমাদের এই প্রতিবেদন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.