শুভঙ্কর বসু: ন্যায্য দাবি আদায়ে কেটে গিয়েছে দু’যুগেরও বেশি। তবুও হার মানেননি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। অবশেষে একুশ বছর পর প্রাপ্য অধিকার আদায় করে নিলেন একাকী এক মহিলা। এই লড়াইয়ে অবশ্য বিচার ব্যবস্থাকে পাশে পেয়েছেন পুরুলিয়ার ওই গৃহবধূ।
কিন্তু, কী জন্য অধিকার আদায়ে এতটা সময় লেগে গেল তাঁর?
কোনও নিখোঁজ ব্যক্তির দেহ না মিললে সাত বছরের আগে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা যায় না। স্বামী নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর রুদা দেবী নামে ওই গৃহবধূকে এই আইনের কথাই শুনিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা ভারত কোকিং কোল লিমিটেড (Bharat Coking Coal Limited)। সেখানেই কর্মরত ছিলেন তাঁর স্বামী। আর সেই কারণেই স্বামীর চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে তাঁকে সাত বছর অপেক্ষা করতে হবে। ওই সময়ই মৃতের পোষ্য হিসেবে চাকরির ব্যাপারটি ভাবা হবে বলেও জানানো হয়েছিল তাঁকে। কর্তৃপক্ষের এমন যুক্তি শোনার পর অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না তাঁর। এদিকে সন্তানদের নিয়ে তখন তাঁর অথৈ দশা। শত কষ্ট হলেও সাতটা বছর প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছেন তিনি।
কীভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন তাঁর স্বামী?
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ের ঘটনা। পুরুলিয়ার তৎকালীন পুলিশ সুপারের রিপোর্ট অনুযায়ী, সেদিন নাইট ডিউটি করছিলেন রুদা দেবীর স্বামী। হঠাৎ একদল দুষ্কৃতী লুঠের উদ্দেশ্য নিয়ে অফিসে হানা দেয়। দুষ্কৃতীদের রুখতে যথাসম্ভব প্রতিরোধ করেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চুরির মাল-সহ প্রমাণ লোপাট করতে রুদা দেবীর স্বামীকেও অপহরণ করে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। পোশাক মিললেও তারপর থেকে তাঁর আর কোনও খোঁজ মেলেনি। পুলিশ সুপার রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন, অপহরণের পর ওই ব্যক্তিকে খুন করে দেহ দামোদরের চড়ে কোথাও পুঁতে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
অভিযোগ, কোল লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে পুলিশের এহেন রিপোর্ট কোম্পানিতে পৌঁছনোর পরও মহিলাকে কোনরকম সাহায্য করেনি তারা। যাইহোক, একে একে সাতটা বছর আশায় বুক বাঁধছিলেন রুদা দেবী। কিন্তু, কোন অদৃশ্য কারণে সাত বছর পরও বিষয়টি কোনও সুরাহা হয়নি। চাকরি তো দূরস্ত! স্বামীর চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা বাবদ প্রাপ্য পাওনাগন্ডাও মিটিয়ে দিতে অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। অবশেষে ২০০৮ সালে বাধ্য হয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৩ সালের মে মাসে রুদাদেবীর পক্ষে রায় দেয় হাই কোর্ট। পোষ্যের চাকরি-সহ স্বামীর প্রাপ্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তাঁকে মিটিয়ে দিতে বলে আদালত।
এখানেই শেষ নয়। হাই কোর্টের এহেন নির্দেশের পরও নানা অছিলায় ওই মহিলাকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছিল কোল লিমিটেড। এবং প্রায় ৬ বছর পর হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চের ওই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে তারা ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সেখানেও হার হয় কোল লিমিটেডের। গত বছর সেপ্টেম্বরে বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় ডিভিশন বেঞ্চও সিঙ্গল বেঞ্চের রায় বহাল রেখে জানিয়ে দেয়, পুলিশি রিপোর্ট অনুযায়ী মহিলার নিখোঁজ স্বামীকে মৃত বলে ধরে নিতে কোনও অসুবিধা নেই। তাই কোল ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষকে তাঁর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা মিটিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি ন্যাশনাল কোল ওয়েজ এগ্রিমেন্টের ৯.৪.২ নম্বর ধারা অনুযায়ী ওই মহিলা বা তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে পোষ্য হিসেবে চাকরি দিতে হবে।
কিন্তু, রুদা দেবীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে একরকম নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েছিল কোল লিমিটেড। ডিভিশন বেঞ্চের এই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে এবার তারা সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) -এর দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সেখানেও শেষ রক্ষা হয়নি। দিন কয়েক আগে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রা ও বিচারপতি কে এম জোসেফের বেঞ্চ ক্ষতিপূরণ-সহ রুদা দেবীর পক্ষে রায় দিয়ে জানিয়েছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এক মহিলাকে তার ন্যায্য অধিকার পেতে একুশ বছর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে। এই গাফিলতির জন্য ওই মহিলাকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে কোল ইন্ডিয়া। সেই সঙ্গে স্বামীর চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় সুবিধা-সহ মহিলা বা তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে পোষ্য হিসেবে চাকরি দিতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.