ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: স্বপ্ন ছিল উকিল হবে। অন্যায়-অবিচারের শিকার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। তাঁদের সুবিচার এনে দেবে। ছোট থেকে তাই স্কুলের বইয়ের বাইরে ছেলেটার বেশি ঝোঁক ছিল আইনকানুনের প্রতি। সারাদিন মোবাইলে-ইন্টারনেটে মুখ গুঁজে ঘাঁটাঘাঁটি করত সে সব নিয়েই। জীবনের লক্ষ্যপূরণে ভবিষ্যতের চলার পথও ঠিক করে ফেলেছিল। “ওসব ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়। আমি উচ্চমাধ্যমিকের পরই ল’কলেজে ভর্তি হব।”- পরীক্ষা দিয়ে ফিরে রাতে খাবার টেবিলে বসেই ঘোষণাও করে দিয়েছিল ইছাপুরের আঠেরোর টগবগে কিশোর শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
বৃহস্পতিবার সকালে উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হয়েছে। দেরি করেননি বাবা বিশ্বজিৎবাবু। ফলপ্রকাশের খবর পেতেই ইন্টারনেট থেকে ছেলের রেজাল্ট ডাউনলোড করেছেন। মনিটরের পর্দায় সজল চোখ রেখে জল ধরে রাখতে পারেননি আর! জ্বলজ্বল করছে -‘শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ৩৬০’। অর্থাৎ ৭৫.২৩ শতাংশ। ল’ কলেজে ভর্তির জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তারপরও যে ল’কলেজে গিয়ে ভরতির লাইনে দাঁড়ানোর জন্য শুভ্রজিৎ আর নেই। সে হারিয়ে গিয়েছে চিরদিনের মতো, পৃথিবী থেকে। করোনা (Coronavirus) নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে, বিনা চিকিৎসায় চলে গিয়েছে মহাশূন্যের পথে।
শুক্রবার দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে কখন! ঘরে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে আছেন বিশ্বজিৎ। পাশে সদ্য পুত্রহারা স্ত্রী। মৃদু ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। “ছেলে কোনও অবিচার সহ্য করতে পারত না। কোনও মানুষের প্রতি অন্যায় হতে দেখলে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ত। তা সে সিনেমাতেই হোক, বা বাস্তব জীবনে। দেখত আর বলত যে, ‘বাবা! আমি উকিল হলে এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াব। বিচার পাইয়েই ছাড়ব।’ কিন্তু ওর সঙ্গেই এমন অবিচার হতে হল!” গলা বুজে আসছিল সন্তান হারানো পিতার।
শোকের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি গোটা পরিবার। পারা সম্ভবও নয়। কিন্তু কান্না আর বিলাপের মাঝে জ্বলছে প্রত্যাঘাতের আগুনও। বিশ্বজিৎবাবু বলছেন, “শুনে নিন, আমি থেমে থাকব না। ছেলের আস্থা ছিল যার উপর, যাকে হাতিয়ার করে নিজের ভবিষ্যৎ গড়বে ভেবেছিল, সেই আইনকে হাতিয়ার করে জবাব নেব। আইনের পথেই শুভ্রজিতের মৃত্যুর বিচার হবে লোকগুলোর। যাদের জন্য আজ আমি সর্বস্বহীন।”
সাঁঝবেলার আলো-আঁধারির মাঝে সামনে মেলে ধরা ছেলের রেজাল্টের প্রিন্ট আউটটা। মাঝে মাঝে সেটা হাতে তুলে নিচ্ছেন, আবার রেখে দিচ্ছেন বিছানার উপর। শুভ্রজিতের জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টার কথা বলে চলেছেন কান্নায় ভেঙে পড়া মা। বলছেন, কীভাবে ওই মাঝরাতে ইছাপুরের বাড়ি থেকে ছেলেকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতাল ছোটাছুটি করেছেন। কীভাবে হাসপাতালের কর্মীদের হাতে-পায়ে ধরা সত্ত্বেও কেউ প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও দেয়নি। ধাক্কা দিয়ে, মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছে মরণাপন্ন কিশোরের দিকে দৃকপাত না করে। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “এই ২৪ জুন সদ্য আঠারো বছরে পা দিয়েছিল শুভ। হাসপাতালে ডাক্তাররা একবারের জন্য ওই ছোট্ট ছেলেটার কথা ভাবলেন না। আমার ছেলের তেমন কোনও সমস্যা ছিল না। তবে কিছুদিন আগে জানতে পেরেছিলাম, সুগারটা বেশি। কিন্তু তাতে এভাবে মারা যাওয়ার কথা নয়। আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে।” হিসহিস ক্রোধে বলছেন, “আমিও ছাড়ব না। যে তিনটি হাসপাতাল আর নার্সিং হোমের অবহেলায় আমার শুভ্রজিতের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে শাস্তি পাইয়ে ছাড়ব।” শুভ্রজিতের বাবা জানাচ্ছেন, “এই হাসপাতাল আর নার্সিং হোমগুলির অমানবিকতার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে সাহায্য চেয়ে আমি হাই কোর্টের বার কাউন্সিলে আবেদন জানিয়েছিলাম। আইনজীবীরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুভ্রজিতের দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এবং আদালতের নির্দেশে তা ময়নাতদন্ত পুরোটাই ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে। এবার বিচার হবে।”
সন্ধে গড়িয়ে রাত। পায়ে পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভেসে এল সন্তানহারা পিতার সকরুণ আর্তি! “আমার ছেলে তো চলে গিয়েছে। আর ফিরে পাব না। কিন্তু ওর মৃত্যুর বিচার করবই। যাতে আমাদের মতো কোনও বাবা-মায়ের এই পরিণতি না হয়।” লকডাউনের ইছাপুরে নির্জন পথে, হ্যালোজেন বাতির হলুদ আলোয় সে কান্নাভেজা আর্তি বেজে উঠছিল দেবতার দুয়ারে শেষ প্রার্থনার মতো।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.