দিব্যেন্দু মজুমদার: রীতিমতো গুগল সার্চ করে বাড়ির ঠিকানা বের করে নিখোঁজ বৃদ্ধকে বাড়িতে ফেরালেন তিন কলেজ পড়ুয়া। দু’মাস আগে গ্রুপের সঙ্গে ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণেশ্বরে তীর্থ করতে এসেছিলেন বৃদ্ধ। তারপর সেখান থেকেই হারিয়ে যান তিনি। বৃ্দ্ধের ছেলেমেয়েরা বহু চেষ্টা করেও খোঁজ পাননি। শেষপর্যন্ত কোন্নগরের ‘নবচেতনা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তিন কলেজ ছাত্র রাস্তার উপর পড়ে থাকতে দেখে তাঁকে উদ্ধার করে কানাইপুর ব্লক হাসপাতালে ভর্তি করেন। বৃদ্ধের বাড়ি খোঁজ করে তাঁর পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওই তিন কলেজ ছাত্র। ইতিমধ্যেই বৃদ্ধের পরিবারের লোকজন কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্তানদের সঙ্গে ঘরে ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে বৃদ্ধ অপেক্ষা করে আছেন।
ওই বৃদ্ধের নাম অনিল দাস (৭০)। বাড়ি ত্রিপুরার অমরপুর রাঙামাটি এলাকায়। দুই মাস আগে এলাকারই একটি গ্রুপের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে তীর্থ করতে এসেছিলেন। কিন্তু দলছুট হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন বৃদ্ধ। দলের সকলে ফিরে গেলেও বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে বৃদ্ধের। ভয়ে দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হন কোন্নগরে। কিন্তু এই দুই মাস ঠিকমতো খাওয়া জোটেনি। ফলে রীতিমতো দুর্বল হয়ে পড়ে তাঁর শরীর। নিজের শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত সোমবার কোন্নগর নবগ্রাম সেবক সংঘের কাছে একটি জলের ট্যাঙ্কের সামনে রাস্তায় শীতের মধ্যে কুঁকড়ে শুয়েছিলেন। হয়তো শীতের প্রচণ্ড কামড়ে মৃত্যু হতে পারত বৃদ্ধের। কিন্তু যার কেউ নেই তাঁদের পাশে সবসময় এসে দাঁড়ায় ‘নবচেতনা’। এই সংগঠনের সদস্য কোন্নগর হীরালাল পাল কলেজের তিন ছাত্র পরীক্ষিত সমাজপতি, সুভাষ দাস ও সন্তু দাসের কাজ হল রোজ রাতে শীতের মধ্যে কোথাও কেউ ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে কিনা তা দেখা আর তাঁদের কম্বল দেওয়া। সোমবার রাতে সাড়ে ১১টায় তিন পড়ুয়া অসহায় মানুষদের খোঁজ করতে বেরিয়েছিলেন। পথে বৃদ্ধকে পড়ে থাকতে দেখে তাঁরা তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁর গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে তাঁর শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু দীর্ঘদিন না খাওয়ার ফলে এতটা দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন অনিলবাবু যে কথা বলতে পারছিলেন না। তাছাড়া, তাঁর পায়ে আঘাত থাকায় ভাল করে হাঁটার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিন ছাত্র তাকে সযত্নে খাইয়ে কানাইপুর বিট হাউসের পুলিশের সহযোগিতায় কানাইপুর ব্লক হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসকদের চেষ্টায় কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর বৃদ্ধ অনিল দাস কোনওরকমে তাঁর নাম ও ঠিকানা বলেন। কিন্তু সেই জায়গায় কী করে যোগাযোগ করা যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন তিন ছাত্র। তাঁরা গুগল সার্চ করে ম্যাপ দেখে রাঙামাটিকে চিহ্নিত করেন। তারপর ওই এলাকার বিখ্যাত কয়েকটি মন্দিরের ছবি দেখালে বৃদ্ধের চোখেমুখে হাসি ফুটে ওঠে। তিনি একটি মন্দির দেখে বলে ওঠেন এটা তাঁর বাড়ির কাছে। গুগলেই ওই এলাকার একটি দোকানের ফোন নম্বর দেখে ফোন করে দোকানদারের কাছ থেকে স্থানীয় থানার ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। তিন পড়ুয়া থানায় ফোন করে ধনেশ্বর দত্ত নামে এক পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বৃদ্ধের ছবি পাঠাতে বলেন। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে বৃদ্ধের ছবি পাঠানোর পর থানা খোঁজ করে অনিলবাবুর ছেলের সন্ধান পায়।
এরপর পরীক্ষিত, সুভাষ ও সন্তু বৃদ্ধের ছোট ছেলে সঞ্জিতের ফোনে ভিডিও কল করেন। ভিডিও কলে ছেলের ছবি দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকেন বৃ্দ্ধ বাবা। অপর প্রান্তে দীর্ঘ দুই মাস বাদে বাবাকে ফোনে কথা বলতে দেখে তিনিও কাঁদতে থাকেন। বাবাকে ফিরে পাওয়ার আশা ক্রমশ যখন ক্ষীণ হয়ে আসছিল, তখন কোন্নগরের তিন কলেজ পড়ুয়া নতুন করে বাবা ও ছেলেদের আশার আলো দেখালেন। বৃদ্ধ অনিলবাবু জানান, ‘আজকে এই তিন ছাত্র যদি তার পাশে এসে না দাঁড়াতেন তবে হয়তো রাস্তাতেই পড়ে মৃত্যু হত।’ তাই পরীক্ষিত, সুভাষ ও সন্তুকে দু’হাত তুলে বৃদ্ধ আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘তোমাদের মতো ছেলেরা আছে বলেই আমাদের মতো বৃদ্ধরা বেঁচে আছে।’ তিন পড়ুয়ার অবশ্য এতে কোনেও হেলদোল নেই। তাদের কথায়, পড়াশোনা করে যদি মানুষের পাশে না থাকতে পারলাম তবে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.