Advertisement
Advertisement
Jaynagar moya

যে মোয়ায় মোহাবিষ্ট আম্বানিও, কোন রেসিপির জাদুতে আজও সেই আকর্ষণ অটুট?

মোয়ার সুবাদেই শীতের তিন মাস ভিড় জমে জয়নগরে।

Speciality about the recipe of Jaynagar moya

বহড়ুতে মোয়া তৈরির কারখানায় চলছে খই পাক দেওয়ার কাজ। ছবি- অরিজিৎ সাহা

Published by: Suchinta Pal Chowdhury
  • Posted:December 18, 2024 2:31 pm
  • Updated:December 18, 2024 3:43 pm  

কনকচূর খইয়ের সঙ্গে মেলে খেজুর গুড়। পাকে পাকে তৈরি হয় মহার্ঘ মোয়া। স্বাদে-গন্ধে তার নস্টালজিয়া এখনও বাঙালির হৃদয় ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে। এককথায় যাকে দুনিয়া চেনে ‘জয়নগরের মোয়া’ বলে। কোন রেসিপির জাদুতে আজও সেই আকর্ষণ অটুট, কেমন চলছে কারবার-খোঁজ নিলেন অভিরূপ দাস

একটুকরো মুখে পুরে মোহাবিষ্ট হয়েছিলেন মুকেশ আম্বানি। ঠিক যেমন নেহরি কোফতা খেয়ে যেভাবে চোখ মুছেছিলেন আকবর। বিশ্ববঙ্গ বাণিজ‌্য সম্মেলনে খই-খেজুরগুড়-ঘি-ক্ষীরের গোল্লা দাঁতে কেটে তেমনই অভিব‌্যক্তি ছিল রিল‌ায়েন্স কর্তার। দেশের ধনীতম শিল্পপতি মুকেশ আম্বানিকে বিস্ময়াবিষ্ট করেছিল ‘জয়নগরের মোয়া।’  

Advertisement

যার সুবাদেই শীতের তিন মাস ছিমছাম জনপদে ভিড়ের হিড়িক। এমনিতে জয়নগর, সাদামাটা জনপদ। আধা গ্রাম আধা শহর। থাকার জন‌্য তেমন ট‌ুরিস্ট লজও নেই তল্লাটে। জয়নগর মজিলপুর পুরসভার ভাইস চেয়ারম‌্যান রথীন মণ্ডলের কথায়, ‘‘নিমপীঠের আশ্রম বাদ দিলে ঘোরার তো কিছু নেই। এক ওই জয়নগরের মোয়া।’’ কনকচূড় ধানের সুগন্ধী খই, খেজুড়গুড়ে পাক দিয়ে, হাত দিয়ে গোল্লা পাকাতে হয়। এই জেনারেশন জেডের যুগে পিৎজা, পেস্ট্রির বাজারকে বিক্রিতে রীতিমতো কাত করে দিচ্ছে হাতে তৈরি খইয়ের গোল্লা। চাহিদা এত যে কর্মচারীরা পেরে ওঠেন না। মোয়া বানাতে বসে যান মালিকরাও। যেমন- বহড়ু বাজারের অন‌্যতম বড় দোকান শ‌্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রঞ্জিত ঘোষ, দুপুরে দুঘণ্টা জিরিয়ে নিয়ে নিজেই বসেন মোয়া বানাতে। তাঁর কথায়, ‘‘গুণমান ধরে রাখতে হলে নিজেকেও হাত লাগাতে হবে।’’

এই মোয়ার অন‌্যতম উপাদান কনকচূড় ধানের খই আর খেজুড়গুড়। এই কনকচূড় ধানের চাষ হয় রায়দিঘি, কাশীনগর, লক্ষ্মীকান্তপুরে। সেই ধান কিনে এনে জয়নগর-বহড়ু-শ্রীপুরের বাড়িতে বাড়িতে ভাজা হয় খই। অনেকেই বেশি খই একসঙ্গে ভাজতে বসিয়েছেন মেশিন। গুড়ের দায়িত্ব ‘শিউলি’-দের। খেজুর় গাছ কেটে যাঁরা হাঁড়ি করে গুড় নিয়ে আসেন তাঁরাই শিউলি। ফি দোকানের বাঁধাধরা শিউলি আছে। কারও দশটা, কারও বা পনেরোটা। নভেম্বরের মাঝামাঝি অর্থাৎ অগ্রহায়ণ থেকেই শিউলিরা খেজুরগাছ কাটা শুরু করে দেন। একটা খেজুরগাছ তিনবার কাটার পর তাতে নলি লাগিয়ে রসের ভাঁড় পাতা হয়। একটা খেজুরগাছ থেকে দিনে দুবার রস মেলে। ভোরের রস জিরেন এবং বিকেলের রসকে ওলা বলে। রস জ্বাল দিয়ে দিয়ে তবেই গুড়। যত ঠান্ডা পড়ে, গুড় তত মিষ্টি। কতক্ষণ ধরে জ্বাল দিতে হবে, সে ‘টাইমিং’ ভালো মোয়ার অন‌্যতম ম‌্যাজিক।

গুড় তৈরি হলে তাতে খই মিশিয়ে পাক দিতে হয়। এরপর মোয়া তৈরির সেকেন্ড ইনিংস। সেটা কেমন? বহড়ু পোলের মোড়ে মহাদেব দাসের মোয়ার দোকান সকলে একডাকে চেনেন। আশি পেরনো মহাদেববাবুর ছেলে গণেশবাবুর কথায়, ভালো মোয়ার জন‌্য ঘিয়ের আদর মাস্ট। গোল্লা পাকানোর আগে দু’হাতের চেটোয় মাখিয়ে নেওয়া হয় ঘি। হালকা কাজুবাদাম কুচি, একটুকরো কিসমিস, পরিমাণ মতো খোয়া ক্ষীর। বাকিটা স্রেফ সময় আর পরিমাণের নিখুঁত টাইমিং। সে মোয়া বানিয়ে রাখলে তিনহাত দূর থেকে ম ম গন্ধ। আর মুখে দিলে? শ‌্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্পেশাল জয়নগরের মোয়া গিয়েছিল ২০২৩-এর বিশ্ববঙ্গ বাণিজ‌্য সম্মেলনে। শোনা যায় সে মোয়ায় কামড় দিয়ে অভিভূত হয়েছিলেন খোদ মুকেশ আম্বানি। হাসেন রঞ্জিত ঘোষ। ষাট পেরনো রঞ্জিতের কথায়, ‘‘স্বাদ কি আর এমনি হয় দাদা। দেশ স্বাধীনের সময়কার দোকান। বাবা হয়ে এখন আমার হাতে। সিক্রেট তো একটা আছেই।’’

মোটামুটি একেকটা পাকে দশ কিলো খই লাগে। কোয়ালিটি ধরে রাখতে গেলে দশ কেজি খইতে খুব বেশি হলে ৩২০ পিস মোয়া বেরোয়। মোয়ার কারিগররা বলছেন, একটু ভালো সাইজের মোয়া মানে ন’টায় পাঁচশো গ্রাম। যার এক কেজির দাম ঘোরাফেরা করে পাঁচশো থেকে ছয়শো টাকার মধ্যে। অনায়াসে একটা বড়দিনের কেক কেনা যায় সে টাকায়। তবু মোয়া? বহড়ু-জয়নগরের দোকানিরা বলছেন, যতই শহরে ঝাঁচকচকে জিরাফের গলার মতো শপিং মল হোক, তাজমহল তো একটাই। হাতে বানানো। ও দেখতে লোক আসবেই। জয়নগরের মোয়া তেমনই।
                                                                                                                          আজ প্রথম পর্ব

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement