তরুণকান্তি দাস ও বিক্রম রায়: তিনদিন মর্গে বন্দি সাত বছরের বাচ্চার শরীরে যেন কাটাকুটি খেলা। তার উপর পড়ন্ত বিকেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কান্না-ক্লান্ত জোড়া শরীর। আছাড়ি-পিছাড়ি খাওয়া বাবা-মাকে ধরে রাখাটাই দায়। বাড়ির ত্রিসীমানায় তখনও কেউ নেই। মাইকে চলছে অভয়বাণী, সামসিনা খাতুনের মৃত্যু করোনায় হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গত তিনদিন একঘরে হয়ে থাকা পরিবারটির পাশে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও তেমন কেউ নেই। বাচ্চা মেয়েটির দাফনের প্রস্তুতিতেও একা, বড়ই একা সামশুল সাহেবের পরিবার। এবং চারদিকে শুধুই সন্দিগ্ধ চোখ। কেউ মারা গেলে পাড়াপ্রতিবেশী হুমড়ি খেয়ে পড়েন, সাহায্য-সান্ত্বনার জন্য হাজির হয় অসংখ্য হাত। গ্রামীণ সেই সহমর্মী চরিত্রটাও যে বেমালুম উধাও স্রেফ করোনার আতঙ্কে। এটাও একটা রোগ বটে।
সামসিনা খাতুন। কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের মাথাভাঙা ২ নম্বর ব্লকের আঠারোকোটা কালপানি গ্রামের মেয়েটি সদরের মেডিক্যালে মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছিল ধুম জ্বর নিয়ে। এবং মৃত্যু হয় সেদিনই। বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্দেহ মেলে দিল তার ডানা। তাই করোনা সংক্রমণে মৃত্যু কিনা জানতে তার লালারসের পরীক্ষা করানো হয়। সেদিন থেকেই সন্তানহারা সামশুল সাহেবের পরিবারের শুরু বিভীষিকার দিনরাত্রি। যা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলেন বৃহস্পতিবার সকালে, যখন জানা গেল করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ। কিন্তু শান্তি এল, এমনটা বলা যাচ্ছে না। সামসিনার মা জ্যোৎস্না বিবিকে ফোনে ধরা হলে বলেন, “গত প্রায় ৫০ ঘণ্টা আমরা দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। মর্গের সামনে গিয়ে হত্যে দিয়ে বসে থাকতেন কখনও মেয়ের বাবা। কোনও সময় তার দাদা। অপেক্ষা, কখন মেয়ের দেহ হাতে পাব। আদৌ পাব কিনা। মেয়ের মুখটুকু আর কখনও দেখতে পাব? মেয়ে পচছে মর্গে। আমরা বন্দি ঘরে।” সামসিনার দাদা মইনুল হক বিকেলেও ফোনে কাঁদছেন। এবং সেই কান্না যতটা তাঁর বোনকে হারানোর শূন্যতায়, তার চেয়েও যেন বেশি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। সেখানেও যে মহাশূন্যতা। কেননা, সবাই জেনে গিয়েছে সামসিনা করোনা নেগেটিভ। তবুও….।
ভবিষ্যৎ তো কেউ জানে না। মইনুলও জানেন না। কিন্তু গত দু’দিন কী হয়েছে তা বলতে গিয়ে টানটান কোনও থ্রিলার বলে গেলেন যেন। “বোন মারা গিয়েছে শুনে আমরা যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছি, তখন পাড়ার লোকজন স্পষ্ট বলে দিলেন, কেউ যেন বাড়ির বাইরে পা না রাখেন। তৈরি করা হল ব্যারিকেড। আমাদের আত্মীয় যাঁরা আসতে চাইলেন, সবাইকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। ঢুকতেই দেওয়া হল না। চাপ বাড়ল। হুমকি চলল। কার্যত একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা বোঝাতে চেষ্টা করেছি, বোনের জন্ডিস হয়েছিল। তারপর জ্বর। তাছাড়া করোনার রিপোর্ট তো আসেনি। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে আমাদের পরিবার।” সামাজিক দূরত্ব না হয় সাবধানতার জন্য জরুরি। কিন্তু এটা তো সামাজিক বয়কট। যা সামাজিক অপরাধ। অপরাধ তো বটেই। মেনে নিলেন এই পঞ্চায়েতের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ বর্মন। তাঁর গলায়ও কিছুটা অসহায়তা। বলছেন, “অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ওঁদের একঘরে করে রাখতে বারণ করেছি। প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কী করি বলুন?”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন ময়নাতদন্তের পর কাটাছেঁড়া হওয়া নিথর ছোট্ট সামসিনাকে নিয়ে টিনের চালাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিধ্বস্ত দাদু ইনাস আলি মিঞা। চৈত্রের শেষ সপ্তাহে ‘অ-সামাজিক’ কালবৈশাখী বয়ে যাওয়া সেই বাড়ির উঠোনে তখনও হাতে গোনা একেবারে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। কিছু সময় পর দাফনের জন্য রওনা হলেন তাঁরা। গুটি পায়ে এগিয়ে এলেন সহৃদয় দু’চারজন। কিন্তু আগল সরাতে পারল না পুরো পাড়া। কান্নায় ভেঙে পড়া মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরল না অনেক কান্নাভেজা পড়শি চোখ। যেখানে শুধু সন্দেহ আর অন্ধ বিশ্বাস। করোনার সংক্রমণহীন সামসিনার মৃত্যু খুলে দিল সমাজের অন্য চোখ। যে চোখ নিশ্চিতভাবেই অন্ধ। অকারণ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.