শুভঙ্কর বসু, গড়বেতা: ১৯ বছর আগের এক শীতের সকাল। জ্যোতি বসু সেদিন ইজরায়েল সফরে যাবেন। তখন বিধানসভার অধিবেশন চলছে। ঠিক ছিল বিধানসভায় যোগ দিয়ে সেখান থেকেই বিমানবন্দরে রওনা দেবেন। চূড়ান্ত ব্যস্ততা। হঠাৎ জয়কৃষ্ণকে (জ্যোতিবাবুর আপ্তসহায়ক) তলব, “সুশান্তকে ডেকে পাঠাও।” ডাক মিলতেই সুশান্ত তুরন্ত হাজির। কাছে ডেকে জ্যোতি বসু জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাদের এলাকা ঠিক হতে আর কত সময় লাগবে?”
প্রশ্নটা শুনেই জয়কৃষ্ণকে কানে কানে সুশান্ত শুধোলেন, এবার কতদিনের সফর? জয়কৃষ্ণ বললেন, “সব মিলিয়ে প্রায় দশদিন।” অতঃপর মুখ নামিয়ে সুশান্ত বললেন, “আপনি বিদেশ থেকে ফেরার আগে আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি ফিরে এলে ভাল খবর দিতে পারব।” তার পরেরটা রক্তঝরা ইতিহাস। বাংলার রাজনীতিতে লাল সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছিল মেদিনীপুর (তখন অবিভক্ত)। যার শুরুটা হয়েছিল গড়বেতা দিয়ে। ‘নায়ক’ আর কেউ নয়, জ্যোতিবাবুর স্নেহধন্য সুশান্ত ঘোষ। হাড় হিম করা সন্ত্রাস দেখেছিল গড়বেতার ছোট আঙারিয়া আর দক্ষিণ পিয়াশালার মানুষ। যার সুবাদে রাতারাতি তৎকালীন রাজ্য রাজনীতির ফোকাসে এসে পড়েছিলেন সুশান্ত। তখন সবেমাত্র বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জ্যোতি বসু। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে চলেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০১-এ সেই নির্বাচনেই ‘এবার নয় নেভার’ স্লোগানকে সামনে রেখে রাজ্যের মসনদ দখলের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ উত্তপ্ত কেশপুর-গড়বেতা।
দীর্ঘ সময় বামেদের একাধিপত্য বজায় থাকলেও পশ্চিমাঞ্চলের সেই এলাকাগুলির নিয়ন্ত্রণ তখন তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে যাচ্ছে৷ আর একটা একটা করে সেই এলাকা ফের বামেদের দখলে আনতে পাল্টা লড়াই চালাচ্ছিলেন সেই দীপক সরকার, সুশান্ত ঘোষ। এলাকাগুলিতে ফের বামেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কারণেই সেই কঠিন নির্বাচন সে যাত্রায় উতরে যেতে পেরেছিল বামেরা। যার অন্যতম নেপথ্য নায়ক ছিলেন অবশ্যই সুশান্ত ঘোষ।
সময় বদলেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আমূল পালটেছে গড়বেতা। স্কুল, কলেজ, ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, তিন–তিনটে সেতু। তবু সেই রক্তঝরা দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও আঁতকে ওঠেন গড়বেতার মানুষ। কেটে গিয়েছে ১৮টা বছর! তবু ভোটের ইস্যুতে এতটুকু ফারাক নেই। গড়বেতার ভোটে এখনও ইস্যু ‘নরকঙ্কাল’ আর সুশান্ত ঘোষ। কিন্তু সিপিএম তো অতীত। তাছাড়া সুশান্ত তো গড়বেতায় আর ঢুকতে পারেন না? ২০১৬-তেই তো ওঁকে প্রার্থী করেনি দল। “না ঢুকুক। ও এলেই আবার সব শুরু হবে। কম অত্যাচার করেনি। লোকের বাড়ি জ্বালিয়েছে, ধান কেটে নিয়েছে, কত খুন করে গুম করেছে তার হিসাব নাই।” শোনাচ্ছিলেন গড়বেতা ১ নম্বর অঞ্চলের সবজি বিক্রেতা রঞ্জন পাত্র। কিন্তু গোটা রাজ্যে বিজেপি মূল প্রতিপক্ষ হলেও গড়বেতায় সিপিএম যে অতীত নয়, মানছেন এলাকার তৃণমূল বিধায়ক আশিস চক্রবর্তী। তিনি বললেন, “এখানে বিজেপি তেমন নেই। সিপিএমই মূল প্রতিপক্ষ। কারণ ওদের একটা পোলারাইজড ভোট এখানে আছে। এই আসনে ওরাই দ্বিতীয় হবে।”
সবটাই যে সুশান্তর জন্য সেটা বকলমে না মানলেও এলাকার তৃণমূল নেতা পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ বলেন, “সিপিএম কাকে দিয়ে প্রচার চালাবে, যেখানে খুঁড়বে সেখান থেকেই তো কঙ্কাল উঠবে।” তবে রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, ঝাড়গ্রাম আসনে জঙ্গলকন্যা দেবলীনা হেমব্রমকে দাঁড় করিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছে সিপিএম। যদিও আশিসবাবুর দাবি, জিতবেন তাঁদের প্রার্থী বীরবাহা সোরেনই! আর পার্থক্যটা গড়ে দেবে গড়বেতাই। বললেন, “আমার সময় এখানে লিড ছিল ৬৪ হাজার। এবার সেটা সত্তর হবে।” তবে সুশান্ত কিন্তু থেমে নেই। এবারের ভোটপর্বেও প্রচার করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কৃষ্ণনগরের কাছে নাদুরিয়া গ্রামে দলের কৃষ্ণনগর লোকসভার প্রার্থী অধ্যাপক শান্তনু ঝা-র সমর্থনে পথসভায় অংশ নেন সুশান্ত। বিরোধীদের কটাক্ষের জবাবে সেখানে তাঁকে এও বলতে শোনা যায় -“বামেরা ঠিক থাকবেই। যাঁরা ৪২-এর স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা থাকবেন কি না দেখুন। আমরা হারলেও বাম, জিতলেও বাম।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.