সুমিত বিশ্বাস,পুরুলিয়া: “ইবাবা পাড়া গাঁয়ের বিটিরা কী করে রাজমিস্ত্রির কাজ করবে! ইটা হয় নাকি আজ্ঞা? কর্ণিক ধরাটা বিটিদের কাজ নয়।” এই সব প্রশ্ন উপেক্ষা করে সেই ‘কর্ণিক’ ধরেই বনমহলের গ্রামে আজ মডেল শিখারানি মাহাতো, সোনামণি সোরেন, জলেশ্বরী হাঁসদা, রূপসান বিবিরা। প্রশাসন বলছে, এরাই সমাজ পরিবর্তনের প্রতীক। গত একবছরে এরাই বনমহল পুরুলিয়ার বরাবাজার গ্রামে মিশন নির্মল বাংলা প্রকল্পে ১৩০০ শৌচাগার নির্মাণ করেছেন।
কাজ শুরুর পর থেকেই পুরুষেরা নানা গঞ্জনা শুনিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর সামনেও ইচ্ছেশক্তি হার মানেনি। সমাজ বাঁকা চোখে দেখলেও তারা কোদাল, শাবল হাতে এখন পুরোপুরি রাজমিস্ত্রি। তাই তাঁদের ডাক পড়ছে অন্য গ্রাম থেকেও। পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল বরাবাজারের বাঁশবেড়া গ্রামের এই সাত মহিলার লড়াই করে পাওয়া সাফল্যের কাহিনী এখন দেখা যাচ্ছে ইউটিউবে। বরাবাজার ব্লক প্রশাসন ‘উড়ান’ নামে সেই সাফল্যের গল্পকে ভিডিওর আকারে ইউটিউবে পোস্ট করেছে। সেই ‘উড়ান’ ভিডিওতেই শান্তি মাঝি, শিখা সিং সর্দার ও শিখারানি মাহাতোর এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন-সহ রাজ্যের পঞ্চায়েতও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, “যে চুল বাঁধেন সে রাঁধেও। বরাবাজারের এই মহিলারা যেন তা আরও একবার প্রমাণ করলেন। তাদের এই কাজ দেখে আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন।”
তবে এই সাফল্যের পিছনেও কিন্তু স্বনির্ভর দল। মিশন নির্মল বাংলায় শৌচাগার তৈরি করে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে যখন প্রশাসনের হিমশিম অবস্থা। তখনই এই শিখারানি, জলেশ্বরীরা ঠিক করেন তারাও রাজমিস্ত্রির কাজ করবেন। ব্যস, এই প্রস্তাব মিশন নির্মল বাংলার কাজে যুক্ত নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ লোকশিক্ষা পরিষদের কানে যেতেই তাঁরা ওই এলাকার কুড়ি জন মহিলাকে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। সেই সময়ই গ্রামের পুরুষ মানুষদের কাছে নানান কথা শুনতে হয় তাদের। কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে যান তাঁরা। প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে তাঁদের কাজ সেভাবে চোখ না টানলেও পরে আবার হাতে–কলমে শিখে এখন প্রতি মাসেই তারা আট থেকে ন’হাজার টাকা রোজগার করছেন। তাদের কথায়, “পুরুষ মানুষের এই কাজ যে আমরা করতে পারব তা ভাবিনি। এই কাজ শেখার সময় কতজন কত কি বলেন! কিন্তু সেগুলি কানে না তুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ করছি। এই কাজে ফি মাসে যে টাকা আসছে তাতে সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। নিজের মত করে খরচ করতে পারছি।” এবার তাঁরা চান, রাজ্য সরকারের বাংলা আবাস যোজনার বাড়িও তৈরি করতে।
এখন এই সাত মহিলার দল তিন দিনে একটি শৌচাগার তৈরি করে দিচ্ছেন। বরাবাজারের বিডিও শৌভিক ভট্টাচার্য বলেন, “এই কাজ মূলত পুরুষরাই করতেন। রাজমিস্ত্রির কাজে মহিলাদের সেভাবে চোখে পড়ে না। তাই আজ শিখারানি, সোনামনি, জলেশ্বরীরা সমাজ পরিবর্তনের প্রতীক।” তাই তো শিখারানি ইউটিউবের ওই ভিডিওতে সাইকেল নিয়ে কাজ সেরে বাড়ি যাওয়ার পথে কর্নিক হাতে বলছেন, “এই কর্ণিকটা পুরুষ মানুষের হাতে আছে না মহিলার কাছে আছে সেটা কর্ণিকটা জানে না। সে জানে একটা কাজের মানুষের হাতে রয়েছে।” আর এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে সাত মহিলার উড়ান।
ছবি: অমিত সিং দেও
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.