নব্যেন্দু হাজরা: ধুলো জমে যাওয়া জমির কাগজপত্র আবার আলমারির লকার খুলে বের করা শুরু করেছেন বেড়াবেড়ির শিশির ঘোষ৷ টাটার প্রকল্প এলাকায় দু’বিঘে জমি ছিল তাঁর৷ বেলা হতে না হতেই বাড়ি থেকে সটান হাজির হয়ে গিয়েছেন কাঁটাতার ঘেরা কারখানার চৌহদ্দিতে৷ ঢোকার অনুমতি নেই৷ বাইরে থেকেই সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ একরাশ প্রতীক্ষা দু-চোখে৷ জমি ফেরতের আইনি বাধা কেটেছে৷ আর তর সইছে না যেন৷
বেড়াবেড়ির পূর্বপাড়ার বাসিন্দা কাশীনাথ ঘোষ স্বেচ্ছায় শিল্পের জন্য জমি দিয়েছিলেন সেই সময়৷ টাকা পেয়েছেন৷ কিন্তু শিল্প হয়নি৷ উল্টে সেই জমিই আবার ফেরত পাওয়ার খবরে এখন উচ্ছ্বসিত তিনি৷ শিল্পের আক্ষেপ মিটেছে এমনটা নয়৷ তবে জমি ফেরতের খবরে অনেকটা হাসি ফুটিয়েছে এই পরিবারের সদস্যদের মুখে৷ কাশীনাথবাবু বললেন, “শিল্প-কৃষি দুইই থাক৷ কিন্তু জমিটা যেন পড়ে না থাকে৷ তাই জমি ফেরত এলে ভালই হবে৷”
এমন ছেঁড়া-ছেঁড়া ছবিই বৃহস্পতিবার দিনভর উঠে এল কাশফুল ফোটা সিঙ্গুরের মাটি থেকে৷ শরৎ যেন এবার আগেই উৎসব বয়ে নিয়ে এসেছে এক দশকের অপেক্ষার শেষে৷ সিঙ্গুর দিন গুনছে সবুজ ফসলের জন্য৷ সিঙ্গুর অপেক্ষায় নতুন ধানের গন্ধের জন্য৷ সেই অপেক্ষায় ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক সবাই৷
কার জমি কোথায়? কী তার অবস্থা? জমির মাপজোক কবে শুরু হবে?
এসব আলোচনাতেই মগ্ন এখন বাজেমেলিয়া, গোপালনগর, খাসের ভেড়ি, বেড়াবেড়ির বাসিন্দারা৷ এখানকার অধিকাংশ পরিবারের জমিই রয়েছে টাটা প্রকল্পের এই এলাকায়৷ কারও বা এক বিঘে আবার কারও বা ১৫ বিঘে৷ যাঁরা জমি স্বেচছায় দিয়েছিলেন, তাঁদের কাগজপত্র নেই৷ তাঁরা কী দেখাবেন? কীভাবে জমি ফেরত পাবেন? আবার যাঁর জমি যেখানে ছিল সেখানেই তিনি জমি পাবেন তো! এসব নিয়েই বৃহস্পতিবার গোটা দিন কেটেছে সিঙ্গুরবাসীর৷ আলাদা উচ্ছ্বাস নেই৷ তবু মুখে রয়েছে সাধের হাসি৷ ভরসা সেই মমতাতেই৷
২০০৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যে আড়াই বছরের মেয়েটাকে মায়ের কোলে করে জেলে যেতে হয়েছিল, সেই পায়েল বাগ এখন একটু বড় হয়েছে৷ বেড়াবেড়ি সূর্যনারায়ণ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সে৷ দুপুর আড়াইটে নাগাদ পূর্বপাড়া দিয়ে যাওয়ার পথেই দেখা হল পায়েলের সঙ্গে৷ সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছিল৷ মুখে হাসি৷ যখন তাকে জেলে নেওয়া হয়েছিল, তখন সে কিছুই বুঝত না৷ এখন একটু বোঝে৷ বলল, “খুব আবির খেলেছি৷ আমার মায়েরা যে লড়াই করেছিল জমির জন্য, সেই জমি আবার ফেরত পাবে বলে শুনেছি৷ বাবা আবার চাষ করতে পারবে৷ খুব ভাল লাগছে৷” এদিন আর স্কুলে ক্লাস করতে হয়নি পায়েলকে৷ স্কুলে ঢুকতেই শিক্ষক-শিক্ষিকারা বুকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে৷ স্কুলেও চলেছে খুশির হাওয়া৷ পায়েলের মা কৃষ্ণা বাগ বলেন, “সেই দিনটা কখনও ভুলব না৷ কোলে বাচ্চা নিয়ে তিন দিন জেলে কাটিয়েছিলাম৷ মেয়ে দুধ খেতে চেয়েছিল৷ খুব খিদে পেয়েছিল ওর৷ কাঁদছিল৷ পুলিশকে বলেছিলাম৷ কিন্তু কেউ একটুও দুধ দেয়নি৷ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও৷ তাই জমি ফেরতের রায়ে খুব আনন্দ হচ্ছে৷”
অষ্টুরানী কোলে, কল্পনা দাস, বাসন্তী দাসেদের চওড়া হাসিই বলে দিচ্ছিল, খুশির হাওয়া বইছে সিঙ্গুরের বাতাসে৷ অষ্টুরানীদেবীর গলায় অবশ্য তখনও শ্লেষ৷ বললেন, “বুদ্ধবাবু যে তিন ফসলি, চার ফসলি জমি দখল করেছিলেন, এখন সেই অবস্থাতেই জমি ফিরিয়ে দিক৷” কল্পনাদেবী জানান, “আমাদের সাত বিঘে জমি রয়েছে৷ সে জমির কী হাল কে জানে! তবে এতদিনে যে তা ফেরত পাচ্ছি এই অনেক৷ প্রশাসন যেখানে জমি দেয় নেব৷”
এসবের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে আজকের সিঙ্গুর দিবসের প্রস্তুতি৷ উজ্জ্বল সংঘ, শক্তি সংঘ–সব ক্লাবেই এখন খুশির ঝড়৷ আজ সব এলাকা থেকেই মিছিল বের হবে সিঙ্গুরে৷ চলবে উৎসব৷ কৃষিজমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা মানিক দাস বলেন, “প্রশাসন যেভাবে নির্দেশ দেবে সেভাবে কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়াটাই এখন আমাদের কাজ৷ এই কাজ যাতে ঠিকভাবে করা যায় সেবিষয়ে সবরকম ব্যবস্থা করা হবে৷ একইসঙ্গে এত বছরের প্রতীক্ষার ফল মিলেছে৷ তাই সবাই আমরা এখন খুশির উৎসবে মেতেছি৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.