অভিযুক্ত রাহুল জাট।
অর্ণব আইচ: এ যেন থ্রিলার সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়! বেছে বেছে মহিলাদের আক্রমণ। ধর্ষণ করে খুন। সঙ্গে লুটপাট। অপরাধের জায়গা চলন্ত ট্রেনের বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য সংরক্ষিত কামরা। কারণ নিজেও বিশেষভাবে সক্ষম। অপরাধের জায়গা মাঝে মধ্যে বদলে স্টেশন সংলগ্ন এলাকাও হয়ে যায়। আপতত দৃষ্টিতে শান্ত স্বভাবের ব্যক্তিটি চলন্ত ট্রেনে করে চলেছে একের পর এক খুন। রাজস্থানের ‘সিরিয়াল কিলারে’র কীর্তি চমকে দিয়েছে দুঁদে পুলিশকর্তাদেরও। গ্রেপ্তারের পর স্বীকারও করে নিয়েছে একাধিক খুন করেছে সে। এমনটাই দাবি পুলিশের।
ঘটনা কী? সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেনে মহিলাদের ধর্ষণ করে খুন ও বাংলার বালির এক তবলা শিক্ষককে খুনের ঘটনা সামনে আসে। শেষ স্টেশনে চাদরে মোড়া দেহগুলো উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। কোনও কুলকিনার করতে পারেনি তারা। প্রতিটি খুনের ‘ট্রেডমার্ক’ ছিল দেহগুলো চাদরে ঢাকা থাকত। তদন্তের জন্য সেটা খুব বড় ‘ক্লু’ নয় বলেই মত পুলিশকর্তাদের। কারণ, দেহ লুকিয়ে রাখার জন্য চলন্ত ট্রেনে চাদরের থেকে ভালো বিকল্প কিছু হয় না বলেই মত তদন্তকারীদের একাংশের। এমন কিছু যোগসূত্রও পাওয়া যায়নি যাতে মনে হবে খুনগুলো কোনও একজনই করেছে।
গত ১৯ নভেম্বর গুজরাটে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯ বছরের এক তরুণীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। নির্যাতিতা টিউশন থেকে উদ্ভাদা রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ধরে বাড়ি ফিরছিলেন। ফোনে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। আচমকা কথা বন্ধ হয়ে যায়। ফোনটিও সুইচ অফ করে দেওয়া হয়। বন্ধুটি পরিবারকে সেই কথা জানায়। তার অভিযোগ, কেউ তরুণীর মুখ চেপে ধরে অপহরণ করেছে। স্টেশন চত্বরে তল্লাশি শুরু হয়। সন্ধে ছটার দিকে ঘাসের জঙ্গল থেকে তরুণীকে অবেচতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাঁকে মোহন দয়াল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। সুরাটের সিভিল হাসপাতালে করা ময়নাতদন্তে উঠে আসে তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। মামলা রুজু করে তদন্তে নামে ভালসাড ডিভিশনের পুলিশ।
কিন্তু প্রমাণের অভাবে খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি তারা। সুরাট ডিভিশনের আইজি, সুরাট ও ভালসাড জেলার পুলিশ সুপার করণরাজ বাঘেলা ঘটনাস্থলে যান। ৪জন ডিএসপি নেতৃত্বে ১০জন পুলিশের বিশেষ দল গঠন করা হয়। সেই দলে রাখা হয় লোকাল ক্রাইম ব্র্যাঞ্চ , সাইবার সেলের আধিকারিকদেরও।
যেখানে তরুণীর দেহ পাওয়া যায় সেই স্থানে কোনও সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষ দলও খুব একটা অগ্রগতি করতে পারেনি। পরে ৫০ জনের একটি দল গঠন করে পুরো এলাকায় তন্নতন্ন করে তল্লাশি করা হয়। উদ্ধার হয় একটি ব্যাগ। সেই ব্যাগে জামা উদ্ধার হয়। সেই জামা দেখে পুলিশ জানতে পারে ভালসাড জেলার ভাপি রেল স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজে একজন ব্যক্তিকে একই ব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে ও জামা পরে যেতে দেখা গিয়েছে।
সেই সিসিটিভি ফুটেজের উপর ভিত্তি করে ১০০ জনের একটি দল তৈরি করা হয়। যাঁরা ওই ব্যক্তির গতিবিধির একটা রুটম্যাপ তৈরি করেন। এদিকে ওই ফুটেজ গুজরাট-সহ মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের বিভিন্ন জেলে পাঠানো হয়। সেখানে থেকে আসে ক্লু। সুরাটের লাজপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে অভিযুক্তের অতীতের অপরাধ ও নাম পরিচয়, ছবি হাতে পায় পুলিশ। জানা যায়, অভিযুক্ত হরিয়ানার রোহতক জেলার বাসিন্দা। আগেও বিভিন্ন অপরাধে তার নাম জড়িয়েছে। সূত্র মারফত পুলিশ জানতে পারে, ২৪ নভেম্বর অভিযুক্ত বান্দ্রা থেকে বান্দ্রা-ভূজ ট্রেনে সফর করছে। পুলিশ, আরপিএফ, জিআরপির যৌথ দল অভিযান চালায়। সেই অভিযানে রাহুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই গ্রেপ্তারির পরই ঘুরে যায় কাহিনির মোড়! উঠে আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটা ধর্ষণ, খুনের অপরাধের ঘটনা! পুলিশের দাবি, সব অপরাধের কথা নিজেই স্বীকার করেছে রাহুল। অভিযোগ, অক্টোবরে মহারাষ্ট্রের সোলাপুর স্টেশনের কাছে ট্রেনে এক মহিলাকে ধর্ষণের পর খুন করেছিল সে। শনিবারও তেলঙ্গানার সেকেন্দ্রাবাদ রেল স্টেশনের কাছে একটি ট্রেনে এক মহিলাকে খুন করে ধৃত। খুনের পর মহিলার গহনা ও নগদ টাকা ছিনতাই করে এলাকা ছেড়ে চম্পট দেয়। ডাউন কাটিহার এক্সপ্রেসে বালির তবলা বাদককেও খুন করে সে। পুুণে-কন্যাকুমারী এক্সপ্রেসে এক মহিলাকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগও উঠেছে। এর পর থেকেই পুলিশের চোখে ধুলো দিতে বারবার অবস্থান বদলাচ্ছিল সে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রবিবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই তথ্য পেয়ে গুজরাট যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজ্য পুলিশের একটি দল। এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতিম সরকার ভবানী ভবনে বলেন, “বালির তবলা শিক্ষকের মোবাইল ফোনের লোকেশন ধরে আমরা অভিযুক্তের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলাম। সেই মতো স্টেশনগুলোকে অ্যালার্ট করতে থাকি। তার পর সেলিমে গিয়ে ফোনটি সুইচ অফ হয়ে যায়। তার পর সেখান থেকে কী করে অভিযুক্ত গুজরাটে গেল তা জিজ্ঞাসাবাদের পর পরিষ্কার হবে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.