সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ক্রমশ ধসে যাচ্ছে মাটির দেওয়াল। ফি দিন কোনওভাবে মাটি লেপে লেপে দেওয়ালকে যেন ধরে রাখা হয়েছে। গত বর্ষায় একদিকের দেওয়াল পড়ে গিয়েছিল। তা এখনও ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। টিনের চালায় সেই ভাঙা ঘরেই থাকা, লেখাপড়া। আর সেখানেই সাজানো সারি সারি সরস্বতীর মূর্তি। সেসব কাঠামোয় রং দিয়ে, শাড়ি পরিয়ে ফিনিশিং টাচের অপেক্ষা। তার পর শুরু হবে বিক্রি। সরস্বতী পুজোর (Saraswati Puja 2024) বেশিদিন বাকি নেই যে! তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেই বাগদেবীর মূর্তি গড়েছে পুরুলিয়ার জয়পুরের পরীক্ষার্থী।
কথাটা শুনে অবাক লাগছে? কিন্তু এটাই একেবারে বাস্তব সত্যি পুরুলিয়ার (Purulia) জয়পুর সদরের সূত্রধর পরিবারে। আর্থিক সমস্যায় বাবা, দাদার সঙ্গে মূর্তি গড়ে সংসারের হাল ধরেছেন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অপূর্ব সূত্রধরও। পুরুলিয়া-রাঁচি সড়কে জয়পুর থানার পাশে দুর্গা মন্দিরের উলটোদিকে তাদের ভাঙাচোরা বাড়ি। এলাকায় তাকে সবাই ভোলা নামে চেনে। ১৬ বছরের এই কিশোরের মূর্তি (Idol making) তৈরির নৈপুণ্যে মুগ্ধ এলাকার মানুষজন। তাই এবার ৪০ টি মাঝারি মাপের সরস্বতী প্রতিমা গড়ছে সে।
দাদা রাহুল প্রতিমা গড়তে মানবাজার গিয়েছেন। বাবা রথু সূত্রধরও সারাদিন এই কাজেই ব্যস্ত। আর অপূর্ব এখন সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর খাওয়াদাওয়া সেরে প্রতিমা গড়ার কাজে হাত দেয়। তার পর টানা সন্ধে পর্যন্ত এই কাজ চলে তার। সন্ধে থেকে আবার পরের দিনের পরীক্ষার প্রস্তুতি। একের পর এক পৃষ্ঠা উলটে ঝালিয়ে নেওয়া সারাবছরের পড়াশোনা। অপূর্বর কথায়, “প্রতিমা গড়েই আমাদের সংসার চলে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই সরস্বতী পুজো। ফলে সংসারের কথা ভেবে পরীক্ষার মাঝেই প্রতিমা তৈরি করতে হচ্ছে।”
১১ বছর বয়স থেকে প্রতিমা গড়ছে অপূর্ব। বাবার কাছেই তার হাতেখড়ি। একদম প্রথম দিকে বাবা মাটি, রঙ সব কিছু এনে দিতেন। আর এখন পুকুরের পাশ থেকে মাটি তোলা, বাজার থেকে রঙ নিয়ে আসা। বিদ্যার দেবী সাজাতে শাড়ি, গহনা সহ নানান জিনিস কেনা এই কাজ এখন নিজ হাতে অপূর্ব-ই করে থাকে। পরীক্ষা শুরুর আগেই সে প্রতিমা তৈরির উপকরণ নিয়ে এসেছে। জয়পুর আর বি বি হাই স্কুলের ছাত্র অপূর্ব এখন প্রতিমার শিল্পকর্ম থেকে যা আয় হয় সেই দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালায়। সরস্বতী ছাড়াও সে মনসা, বিশ্বকর্মা, কালী এমনকি দুর্গা প্রতিমাও তৈরি করে।
এবার বড়গ্রাম হাইস্কুলে তার পরীক্ষার আসন পড়েছে। অপূর্ব শিল্পকর্মের কথা ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ-সহ সেখানে পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রছাত্রীরা জেনে গিয়েছে। সকলেই তার এই কাজের তারিফ করছেন। তাই এলাকার মানুষজন তাকে বলে অপূর্ব ‘ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো।’ ভাঙা ঘরের কথা শুনলেই মনটা হু হু করে ওঠে এই কিশোর শিল্পীর। তার মা দোলন সূত্রধর বলেন, “ঘরের এমনই অবস্থা যে ঘরের বাইরে রাস্তার পাশে রান্না করতে হয়। ঘরের জন্য পঞ্চায়েত থেকে ব্লক কত যে দৌড়েছি। কিন্তু ঘর পাইনি। একটা পাকা ছাদ পেলে অপূর্ব হয়তো আরও ভালো কাজ করতে পারবে।”
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.