সন্দীপ মজুমদার, উলুবেড়িয়া: অনিতা প্যালেসে সেদিন লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ দুধ সাদা দোতলা বাড়িটার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষারত সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরাও উসখুস করতে শুরু করেছেন। সকলের মুখেই এক প্রশ্ন কখন আসবেন প্রার্থী? কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনিতা প্যালেসের বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াল মাহিন্দ্রা কোম্পানির পার্পল রঙের এক্সইউভি-৫০০ গাড়িটি। গাড়ির চালকের আসন থেকে নেমে এলেন সারিক আনোয়ার। উলটোদিকের দরজা খুলে রাস্তায় পা রাখলেন উলুবেড়িয়ার বিদায়ী সাংসদ সাজদা আহমেদ। প্রয়াত সাংসদ সুলতান আহমেদের স্ত্রী ও পুত্রকে ঘিরে শুরু হল এক অদ্ভুত উন্মাদনা। এতক্ষণের নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে যেন হঠাৎ করে তুফান এল। অপেক্ষারত জনতার মধ্যে থেকে গগনভেদী চিৎকার উঠল, “সাজদা আহমেদ জিন্দাবাদ, সুলতান আহমেদ জিন্দাবাদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ।” সকলের হাতে ঘনঘন আন্দোলিত হতে থাকল জোড়াফুল আঁকা পতাকা। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে উলুবেড়িয়া কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সাজদা আহমেদ ছেলে সারিককে পাশে নিয়ে হাত জড়ো করে হাসিমুখে সকলের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। ভিড়ের মধ্যে থেকে সাংসদের উলুবেড়িয়ার আপ্ত সহায়ক রনজিত গঙ্গোপাধ্যায় এগিয়ে এসে তাঁদের দু’জনকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাইরে জনতার উল্লাস চলতেই থাকল।
উলুবেড়িয়া শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে কালো পিচ ঢাকা ছয় নম্বর জাতীয় সড়ক। তার উভয় পার্শ্বেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ব্যস্ত নাগরিক জীবন। এখানে জাতীয় সড়কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংয়ের একটি হল নরেন্দ্র সিনেমা মোড় এবং অপরটি নিমদিঘি। নিমদিঘি থেকে উত্তর দিকে আনুমানিক ৩০০ মিটার এগোলেই যদুরবেড়িয়ার অনিতা প্যালেস। এলাকার উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য ২০১৩ সালে দোতলা এই বাড়িটি ভাড়া নেন তৎকালীন সাংসদ সুলতান আহমেদ। তখন থেকেই তিনি উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের যাবতীয় কাজ এই বাড়িটি থেকে পরিচালনা করতেন। এলাকার মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, তাঁদের সমস্যার কথা শোনা, সমস্যার প্রতিবিধান করা ছাড়াও নাগরিক উন্নয়নের পরিকল্পনা রচনা সবকিছুই পরিচালিত হতো এখান থেকেই। সেই থেকেই অনিতা প্যালেস হয়ে উঠেছে উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের একটি অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। সাংসদকে সমস্ত রকম উন্নয়নমূলক কাজে যথাযথ সহযোগিতা করে এসেছেন উলুবেড়িয়া অফিসের দায়িত্বে থাকা একনিষ্ঠ তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী রণজিত গঙ্গোপাধ্যায়। যাঁকে এক ডাকে সকলে ভোলা গঙ্গোপাধ্যায় নামেই চেনেন। সুলতান আহমেদের আকস্মিক প্রয়াণের পর সাজদা আহমেদ সাংসদ নির্বাচিত হন। বাগনানের বাসিন্দা ভোলাবাবুও একই ভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
সংসদের অধিবেশন না থাকলে প্রতি শনিবার সাজদা আহমেদ অনিতা প্যালেসে স্থানীয় মানুষদের সমস্যার কথা শোনেন এবং তা নিরসনের উদ্যোগ নেন। অন্যান্য দিনের ক্ষেত্রে অবশ্য ফোন করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়। সেদিনও তিনি এলাকার মানুষদের অভাব অভিযোগের কথা শুনছিলেন। তারই মধ্যে কয়েক জন তৃণমূল কর্মী তাঁদের এলাকায় নির্বাচনী প্রচারের জন্য সাজদা আহমেদকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সাজদা আহমেদ মুচকি হেসে সবিনয়ে দলীয় কর্মীদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং একই সঙ্গে পরের দিন ওই এলাকায় প্রচারে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। তিনি জানান এদিন তিনি এলাকার মানুষের সমস্যার কথা শোনার জন্যই অনিতা প্যালেসে এসেছেন। এদিন তিনি কোনও প্রচারে যাবেন না। নির্বাচনী প্রচারের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে তবে তার থেকেও মানুষের সমস্যার পাশে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি জরুরী বলে তিনি মনে করেন। তিনি বললেন, “সকলেই যদি আমরা নির্বাচনী প্রচার নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত হয়ে পড়ি তাহলে এই সব অসহায় মানুষগুলোর কথা কে শুনবে?” তিনি জানান আগামী ২২ মে তারিখ পর্যন্ত তাঁকে নির্বাচনী কাজ তদারকির পাশাপাশি সাংসদের দায়িত্বও পালন করতে হবে। তাই একজন মানুষও যেন তাঁর কাছে সমস্যার কথা বলতে এসে ফিরে না যান সেটা আগে দেখতে হবে। ভোলাবাবু কানের কাছে চাপা স্বরে বললেন, “ম্যাডাম মানুষের সমস্যাকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়েও তিনি এলাকার মানুষের সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করেন।”
সেদিন বহু মানুষ সাজদা আহমেদকে তাঁদের বিভিন্ন রকম সমস্যার কথা জানালেন। তিনি মন দিয়ে সব শুনে যথাযথ পদক্ষেপ নিলেন। শুধু সমস্যাই বা কেন? কেউ কেউ আবার তাঁদের বাড়ির অনুষ্ঠানে সাংসদকে আমন্ত্রণও জানিয়ে গেলেন। কারও বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো, আবার কারও মেয়ের বিয়ে। কারও ছেলের উপনয়ন, আবার কারও নাতির অন্নপ্রাশন কিছুই বাদ গেল না। সব আমন্ত্রণ তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। বস্তুতপক্ষে, সুলতান আহমেদই উলুবেড়িয়ায় সর্বপ্রথম একজন সাংসদ হিসাবে পাড়ার ইতু পুজো থেকে শুরু করে বাড়ির সত্যনারায়ণের সিন্নিতে উপস্থিত থাকার নজির সৃষ্টি করে গিয়েছেন। সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর সাজদা আহমেদ সেই রেওয়াজ ভাঙেননি। যতটা সম্ভব মানুষের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী সুলতান আহমেদ উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের মানুষকে ভালবেসে এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সেই আদর্শকে সামনে রেখেই তিনিও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে থাকতে চান। তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে চান। তাই তিনি এলাকার মানুষের সমস্যাকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.