সুমিত বিশ্বাস, বোরো (পুরুলিয়া): ষাট-সত্তরের দশকে বহু তরুণের হৃদয়ের মধ্যমণি হয়ে তাঁদের হৃদয়ে কাঁপুনি ধরিয়েছিলেন জিনাত আমন। এবারও কাঁপন ধরাচ্ছে জিনাত। কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না বাঘিনীকে। ষষ্ঠ দিনে শুক্রবার প্রায় ২০ কিমি হেঁটে জঙ্গলও বদলে ফেলল সে। এবার সে একেবারে লোকালয়ে ঘুরছে। আর সেই সঙ্গে জিনাতের নামও বদলে দিল সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তিন বছরের জিনাত এখন ‘গঙ্গা’।
‘গঙ্গা’কে খাঁচাবন্দি করতে এদিন দুপুর থেকে অভিযান চলে। রাতে নাইট ভিশন ড্রোনে নজরদারি চালিয়ে প্রায় ৬০ মিটারের কাছে চলে আসে ট্রাঙ্কুলাইজার টিম। এদিনই প্রথম শুধুমাত্র বাংলার ট্র্যাঙ্কুলাইজার টিম জঙ্গলে ঢোকে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ২, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের একজন করে মোট ৪ জন শুটার রয়েছেন। তবে রাতে ঘুমপাড়ানি গুলিতে বাগে আনা সহজ নয়। লোকালয় হওয়ায় আরও সমস্যায় পড়ে বনবিভাগ। তাই মহিষ-ছাগলের তিনটি টোপ দিয়ে জালে ঘিরে রাখে। এদিন বেশি রাত পর্যন্ত ওই জালের ফেনসিং বরাবর ঘুরছিল সতর্ক ‘গঙ্গা’। কিন্তু বাঘবন্দি অভিযানের মধ্যেই জাল ঘেরা জঙ্গল (ডাঙরডি মোড় ) থেকে পালাল সে। এবার একেবারে লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে জিনাত বা গঙ্গা।
আসলে বৃহস্পতিবার রাইকা পাহাড়ে ঝাঁড়া-ভাঁড়ারি টিলায় বাঘবন্দি অভিযানে হাতি তাড়ানোর কৌশল ব্যবহার করাতেই বিপদ বাড়ে। আগুনের গোলা নিয়ে হুলা পার্টির জঙ্গল ঘিরে রাখা। সেই সঙ্গে অভিযানে অংশ নেওয়া বনকর্মীদের যথেচ্ছ পটকা ফাটানো। তাছাড়া গজ শস্ত্র দিয়ে বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার মতো আওয়াজে ওড়িশার বাঘিনী জিনাতের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে প্রায় ২০ কিমি হেঁটে শুক্রবার ভোরে জঙ্গলপথে মানবাজার দুই ব্লকের বোরো থানার কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের মানবাজার দুই বনাঞ্চলের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এই জঙ্গলের ঝোঁপঝাড় খুবই পাতলা। রাইকার মত ঘন নয়। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিপদ মাত্র এক কিমির মধ্যেই লোকালয়। সবে মিলিয়ে লোকালয় হওয়ায় যেমন আতঙ্ক চেপে বসে, তেমনই উৎসাহী মানুষজন দিনভর ডাঙরডি মোড়ের কাছে ভিড় জমান। তবে রাজ্যের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) বিদ্যুৎ সরকার বলেন, “পটকা ফাটানোর আগেই অর্থাৎ অভিযান শুরুর মধ্যেই বাঘটি পাশ দিয়ে এদিকে চলে আসে। রাতেও অভিযান চলছে।”
কিন্তু কেন নাম বদলাল জিনাতের? আসলে স্থানবদলের সঙ্গে সঙ্গে বাঘের নামও বদলে দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্রে থাকাকালীন এই বাঘিনীর নাম ছিল জিনাত, সিমলিপালে ঢুকতেই তার নাম দেওয়া হল ‘গঙ্গা’। কিন্তু এতদিন লেগে গেল কেন? গত ১৫ নভেম্বর জিনাতকে মহারাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসা হয়। ২৮ নভেম্বর সে বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় নাম বদলের সময় পাওয়া যায়নি। অবশেষে তার নতুন নামকরণ হয় ‘গঙ্গা’।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাইকা পাহাড় লাগায়ো কেন্দাপাড়া এলাকায় অভিযানের সময় যে ৩ কিমি জাল বিছানো হয়েছিল সেই নেটই এই এলাকায় লাগানো হয়। যাতে জাল দিয়ে ঘিরে বাঘবন্দি অভিযান সফল করা যায়। তবে বনদপ্তর এই পদক্ষেপ নিলেও জঙ্গল জীবনে ভীষণভাবে অভিজ্ঞ ও সতর্ক জিনাতকে জাল দিয়ে আটকানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানাচ্ছেন সিমলিপাল ও সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকরা। কিন্তু সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের হেডকোয়ার্টার বারিপোদা জানিয়ে দিয়েছে, যেভাবেই হোক জিনাতকে তাদের হাতে চাই। কারণ মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি থেকে জিনাত ও যমুনাকে আনা হয়েছিল সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে রয়্যালের হলুদ রঙ ফিরিয়ে আনার জন্য। আসলে সিমলিপালে জিন গঠিত সমস্যায় ওখানকার অধিকাংশ বাঘের রঙ কালো ডোরাকাটা হয়ে রূপ বদলে গিয়েছে। ফলে দেশের ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত। আর সেই কারণেই সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জিনাত ও যমুনার সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আসল রঙ হলুদ ডোরাকাটা ফিরিয়ে আনতে চায়।
তবে এই ডাঙ্গরডি জঙ্গল শুধু পাতলা নয়। ওখানকার গাছ গাছালিতে ছবি তোলার পাশাপাশি পর্যটকরা বেড়াতেও যান। এছাড়া বনজ সম্পদ কুড়াতেও মানুষজনের আসা যাওয়া রয়েছে। সবে মিলিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় বনদপ্তর। আইন-শৃঙ্খলার যাতে কোন রকম ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। জঙ্গলের একাধিক পথ রীতিমত কর্ডন করে রেখেছে সিভিক ভলান্টিয়ার সহ যৌথ বন পরিচালন কমিটির সদস্যরা। কিন্তু এই সমগ্র ঘটনায় বাঘিনীকে বাগে আনতে যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে তার তুমুল সমালোচনা করেন পরিবেশপ্রেমীরা। যেখানে হাতি তাড়াতে সুপ্রিম কোর্ট হুলা পার্টিকে নিষিদ্ধ করেছে, সেখানে বাঘবন্দি অভিযানে কিভাবে হুলা পার্টিকে ব্যবহার করা যায় সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তারা। পরিস্থিতি এখন এমনই জটিল হতে শুরু করেছে যে, এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশানের তোড়জোড় চলছে। কংসাবতী দক্ষিণ বন বিভাগের কর্তারা বলছেন, জিনাত দক্ষিণ বাঁকুড়ার সুতান হয়ে বারো মাইল জঙ্গল থেকে আবার রাইকা পাহাড়ের দিকেও ফিরে যেতে পারে। যদিও তার ইউ টার্ন বা পিছনে যাওয়ার রেকর্ড নেই গত এক মাসে। সুন্দরবন ও সিমলিপালের ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিজ্ঞ বাঘিনী নিজের টেরিটরি বাড়াতেও এদিকে চলে আসতে পারে। এই এলাকায় হরিণও রয়েছে। সব মিলিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় বনবিভাগ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.