সুমিত বিশ্বাস, ঝাড়খণ্ড: ‘বাঘধরা’তেই বাঘ! তিন দশক আগে ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা-খরসোওয়ার চাণ্ডিল রেঞ্জ-র চৌকা থানার বালিডি জঙ্গলে ওই এলাকার এক বাসিন্দাকে বাঘ জাপ্টে ধরেছিল। তারপর থেকেই এই এলাকার জঙ্গলের নাম ‘বাঘধরা’। আর সেই ‘বাঘধরা’তেই এবার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বলা যায়, অতীতের বাঘের ঘরেই বাঘ! এমন কথা বলছেন বালিডির মানুষজন। জিনাতের মত গলায় রেডিও কলার না থাকা এই বাঘকে ঘিরে রীতিমতো হুলস্থূল ঝাড়খণ্ডের পূর্ব প্রান্তে। আতঙ্কে কাঁটা ওই ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা দক্ষিণ-পশ্চিম পুরুলিয়াও।
কারণ, এই বাঘ যে জিনাতের মতোই ফি রাতে ১৪-১৬ কিমি হাঁটছে। কখনও পুরুলিয়া ছুঁয়ে। আবার কখনও সরাইকেলা-খরসোওয়া বনবিভাগের চাণ্ডিল থেকে আরেক বিভাগ খুঁটির তামাড় রেঞ্জ। তারপর আবার চাণ্ডিলের বালিডিতে ফিরে আসা। তার সংগৃহীত আসা-যাওয়ার পায়ের ছাপ এমন কথাই বলছে। প্রায় বর্ষশেষে জিনাত পুরুলিয়া জেলা বদল করে দক্ষিণ বাঁকুড়ায় ধরা দেওয়ায় তিন রাজ্য ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বাংলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও সেই জিনাতকে খুঁজতে আরেক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আগমনকে ঘিরে আবার রাত জাগা শুরু পুরুলিয়ার বলরামপুর ও বাঘমুণ্ডির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে।
জিনাতকে গুলি দিয়ে ঘুমপাড়ানো শুটার তথা সুন্দরবনের সজনেখালি বিট অফিসার মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, “বাঘেদের চোখে-চোখে কথা হয়। ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড-বাংলার এত বড় বিস্তীর্ণ টানা জঙ্গল। একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। যখন জিনাত ঘরছাড়া হয় সেই এক মাসে এই দীর্ঘ বন্যপ্রাণের করিডরে কোন বাঘের সঙ্গে তার দেখা হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। আর পরিচিত হওয়ার পর সেই টানে আসতেই পারে আরেক বাঘ। একদিকে ঘ্রাণ অন্যদিকে পরিচয়। এই দুই কারণে সঙ্গীকে হাতছাড়া করতে চায় না। সুন্দরবনে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি একবার লোকালয়ে চলে আসা একটি রয়্যাল বেঙ্গলকে লঞ্চে করে বহু দূরে সমুদ্রের কাছে ছেড়ে এসেছিলাম। ২১ দিন পর সে আবার নদী সাঁতরে ফিরে এসেছে। পরে জানতে পারি তার সেখানে সঙ্গী ছিল। ফলে জিনাতের টানে ঝাড়খণ্ডে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।”
ছোটনাগপুর মালভূমির দলমা রেঞ্জ ঘেঁষা পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ডের এই অংশের মানুষজন হাতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে পারলেও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে কীভাবে লড়াই করতে হয় তা জানা নেই এই দলমা-অযোধ্যা পাহাড়তলির মানুষজনদের। তাই বালিডি জঙ্গল ছুঁয়ে থাকা তুল গ্রাম, বালিডি, রাইডি, দুলমি গ্রামের মানুষজন বলছেন, চেনা জঙ্গলটাই যেন বদলে গিয়েছে ওই বাঘের জন্য! সপ্তাহখানেক আগে বালিডির জঙ্গলে যে কিশোর প্রথম রয়্যাল দর্শন করেছিল সেই কিশোর সুমিত মাহাতোর জেঠু দিলীপকুমার মাহাতো বলেন, “কি যে ভয়ে আছি বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের ছেলেটা মৃত্যুমুখ থেকে বেঁচে গিয়েছে। ওই দিনের কথা ভাবলেই হাড়হিম হয়ে আসছে। তবে বাবা-ঠাকুরদার কাছে শুনতাম আজ থেকে ৩২-৩৩ বছর আগে আমাদের বাড়ির পিছনে বালিডি জঙ্গলে বাঘ আসতো। সেই সময় এই এলাকার একজনকে বাঘে ধরেছিল। সেই থেকে জঙ্গল ‘বাঘধরা’ নাম হয়ে গিয়েছে। তবে তিন দশক পর আবার যে সেখানে বাঘ আসবে সেটা এই এলাকার কেউ ভাবেনি।”
ওই কিশোরের আত্মীয় পরীক্ষিত মাহাতো বলেন, “এই জঙ্গলে বাঘের ঘর রয়েছে। তবে সেই ঘরে যে আবার বাঘ আসবে তা ভাবিনি। তবে কবে যে সব স্বাভাবিক হবে কে জানে। আসলে হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি। বাঘের সঙ্গে নয়। তাই সব সময় একটা ভীতি কাজ করছে। আমরা জানি না বাঘের সঙ্গে লড়াই করার কৌশল কী!” তবে ছোটনাগপুর মালভূমির এই এলাকা যে বাঘ থাকার আদর্শ তা মানছেন বনকর্তারা। পুরুলিয়ার ডিএফও অঞ্জন গুহ বলে, “অবাধে জঙ্গল কাটা আমরা রুখতে পেরেছি। নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি জঙ্গলের আগুনও। তাই জঙ্গল বেড়ে যাওয়ায় বন্য শূকর, হরিণ বাস করছে। ফলে খাবার, বাসস্থান সব আছে। জঙ্গলের মধ্যে আছে পাহাড়ি ঝোরাও। ফলে জলপান করার অভাব নেই। তাই এই অঞ্চল বাঘের আবাসস্থল হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।” ২০১৮-১৯ সালে কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিট দিয়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পার হয়েছিল। তার পদচিহ্ন এখনও সংরক্ষণ করে রাখা রয়েছে কোটশিলা বনাঞ্চলে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.