সম্যক খান, মেদিনীপুর: নিজের দলের কাছেই আজ ব্রাত্য নন্দরানী ডল। বিগত বামফ্রন্ট আমলে কেশপুরের বুকে রেকর্ড এক লক্ষ আট হাজার ভোটে জিতেছিলেন তিনি। তার জেতার পদ্ধতি নিয়ে হয়েছিল তীব্র সমালোচনা। সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন সেই সময়ে। পুরস্কারস্বরূপ জুটেছিল পূর্ণমন্ত্রীর পদও। কিন্তু বর্তমানে দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে তিনি শয্যাশায়ী। উপেক্ষিত। পাশে নেই দল। মেদিনীপুর শহরের বিধাননগরের বাড়িতে দোতলার এক ঘরের বিছানাটাই এখন তাঁর সঙ্গী। দলের নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা তো দূরের কথা ফোনে শারীরিক অবস্থার খোঁজখবরটুকুও রাখেন না।
হাই ব্লাড সুগার ও ব্রঙ্কো নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে একপ্রকার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। মাঝে অসুস্থতা এতটাই বেড়েছিল যে দীর্ঘ এক মাস তাঁকে নার্সিংহোমেই ভরতি থাকতে হয়েছিল। সেইসময় একবার বর্তমান জেলা সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ তার সঙ্গে দেখা করে দায়িত্ব সেরেছেন। বর্তমান দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আক্ষেপ থাকলেও সেসব নিয়ে আর এই বয়সে কচকচানিতে যেতে চান না তিনি ও তাঁর স্বামী ডহরেশ্বর সেন।
অথচ অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সেই যুক্তফ্রন্টের আমল থেকেই বিধায়ক হিসেবে কাজ করে আসছেন নন্দরানী। ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলা থেকে যুক্তফ্রন্টের একমাত্র বিধায়ক যিনি ঘাটাল আসন থেকে জিতেছিলেন তাঁর নাম নন্দরানী ডল। তখন সার্টিফিকেটে ২৫ বছরেরও কম বয়স ছিল তার। কিন্তু তৎকালীন বোর্ডের কাছে আবেদন করে তাঁর বয়স বাড়াতে হয়েছিল ভোটে লড়ার জন্য। সেই জেতা। পরপর তিনবার সেই ঘাটাল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে সিপিএম আমলে তিনি কেশপুর থেকে ভোটে লড়েছেন। সেখানেও টানা তিনবার বিধায়ক হয়েছিলেন।
গত ২০০১ সালে তাঁর শেষ নির্বাচনে কেশপুর থেকে ১ লক্ষ ৮ হাজার ভোটের রেকর্ড ব্যবধানে জেতেন তিনি। যার ফলস্বরূপ তাকে রাজ্যের জনশিক্ষা প্রসার মন্ত্রী করা হয়। কিন্তু পরবর্তী ২০০৬ সালে আর তাকে টিকিটই দেওয়া হয়নি। তৎকালীন জেলা সম্পাদক দীপক সরকারী বিরোধী লবিতে অবস্থানের ফলেই তিনি বাদ পড়ে যান। মনে প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও তা মেনে নিয়েছিলেন দলীয় সিদ্ধান্তের কথা ভেবেই। শুধু বিধায়ক বা মন্ত্রীই নন, একসময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মহিলা সমিতির প্রধানও ছিলেন তিনি। পার্টি অন্তঃপ্রাণ।
আজ ৮১ বছর বয়সে শয্যাশায়ী হয়েও তাঁর মাথার বালিশের পাশে রাখা থাকে গণশক্তি। কখনও শুয়ে বা কখনও বিছানাতেই একটু বসে চোখ বোলান গণশক্তির পাতায় পাতায়। প্রতিবেদকের কাছেও খোঁজখবর নিলেন বর্তমান নেতাদের সম্পর্কে। কিন্তু সেই সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছেই আজ তিনি ব্রাত্য। বিধাননগরে তার বাড়ির কাছে একই পাড়াতেই ঢিলছোঁড়া দূরত্বে থাকেন দীপক সরকার। তিনিও বয়সের ভারে ন্যুজ। তাঁর বাড়িতে পার্টি নেতাদের আনাগোনা থাকলেও উপেক্ষিত নন্দরানী। গত সেপ্টেম্বরে প্রায় এক মাস ছিলেন শহরেরই এক বেসরকারি নার্সিং হোমে। সেইসময়কালেই তার চিকিৎসায় প্রায় ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়। এখনও প্রতিমাসে প্রায় বিশ হাজার টাকা খরচ হয় তাঁর ওষুধে। খরচখরচা সব সামলাচ্ছেন তার দুই শিক্ষিকা মেয়ে। পাশে নেই দল। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দলের নেতারা খোঁজখবর না রাখায় আক্ষেপ ফুটে উঠছে প্রতিটি কথাবার্তাতেই। তবে পাড়ার মহিলা সমিতির কর্মীরা মাঝেমধ্যে বাড়ি খোঁজখবরও নিয়েছেন। রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন তার স্বামী ডহরবাবুও। শেষদিকে নবগঠিত ঝাড়গ্রাম জেলার সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাঁকেও বয়সের অজুহাতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ স্ত্রী এবং বাড়ির দেখাশোনা করেই সময় কাটছে তাঁরও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.