ফাইল ছবি
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘এবার বাংলায় দু’শো পার, এবার বিজেপি সরকার’। এই স্লোগান তুলেই বাংলায় গেরুয়া ঝড় তোলার কৌশল সাজিয়েছিল বিজেপি। আসল পরিবর্তনের ডাক দিয়ে তৃণমূলকে বিদায়ের পথ দেখাতে বদ্ধপরিকর ছিল কেন্দ্রের সরকার। কিন্তু ২০০ তো দূর অস্ত, তিন অক্ষরেও পৌঁছতে পারল না পদ্মশিবির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি রাজ্যবাসীর আস্থায় কুঠারাঘাত হানতে চূড়ান্ত ব্যর্থ তারা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে জেপি নাড্ডা, দিনের পর দিন বাংলায় হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও মানুষের মন জয় করতে পারেননি। দেশের একমাত্র মহিলা ‘মুখ্যমন্ত্রী’র গদি ঠিক কতখানি শক্তপোক্ত, তা হয়তো আন্দাজই করতে পারেনি বিরোধীরা। তাই তো ‘চাণক্য’ শাহের গণনাও ডাহা ফেল করল।
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় মাত্র ৩টে আসন পেয়েছিল বিজেপি। সেখান থেকে লোকসভা ভোটের ফল বাংলায় গেরুয়া ঝড় ওঠার ইঙ্গিত দিয়েছিল। অমিত শাহ (Amit Shah) বলেছিলেন, রাজ্যে ২৩টি আসন জিতবে বিজেপি (BJP)। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনেকটাই মিলে গিয়েছিল। ১৮টি লোকসভা আসন জিতে রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিয়েছিল বিজেপি। আর তারপরই নবান্ন দখলকে পাখির চোখ করে এগোতে শুরু করে মোদি সরকার। সেই ভাবেই তৈরি হয় রণকৌশল। শাসকদলের নেতাদের নিজেদের দলে টানা থেকে তোলাবাজি, টেট দুর্নীতি, আমফান দুর্নীতিকে ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন মোদি-শাহরা। বাংলার মানুষের মন জয় করতে এরপর শুরু হয় তাঁদের ঘনঘন বঙ্গসফর।
ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর খোদ মোদি সভা করেন ১৮টি। এরপর ২৩ এপ্রিল চারটি জায়গার সভার বদলে একটি ভারচুয়াল সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন দিল্লি থেকে। তবে নবান্ন অভিযানের লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হয়েছিল মোদির বাংলা সফর। সেই হিসেবে মোট ২০টি সভা করেছেন তিনি। যা এককথায় রেকর্ড। মোদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথরা (Yogi Adithyanath) মিলে প্রায় একশো সভা ও রোড শো করেন। কিন্তু তাতেও আখেরে লাভ হল না।
ঠিক কোন কোন কারণে পিছিয়ে পড়ল বিজেপি?
১. ধর্মীয় মেরুকরণের পথে হেঁটে বাংলায় হিন্দু ভোটারদের টার্গেট করেছিল বিজেপি। হিন্দুদের ভোটেই জয়ের অঙ্ক কষেছিল তারা। কিন্তু সেই কৌশল কাজে আসেনি। বিজেপিকে রুখতে একযোগে তৃণমূলকে জেতানোর চেষ্টা করেছে সব ধর্মের মানুষ বলেই মনে করছে ওয়াকিবহল মহল।
২. রাজ্যে এসে একাধিকবার গরিব, শ্রমিক, কৃষক পরিবারে মধাহ্নভোজ সেরেছেন অমিত শাহ, জেপি নাড্ডারা। কিন্তু এই কৌশলও তাঁদের বিপক্ষেই গিয়েছে। তৃণমূলের তরফে এই ইস্যু নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আমফান, কোভিডের সময় কোথায় ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতারা? জাত-পাতের বিভেদ ভোলাতে তাই এই তত্ত্বও কাজে দেয়নি।
৩. বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘বহিরাগত’ বলে বারবার বিঁধেছে তৃণমূল। সেই ‘বহিরাগত’ কটাক্ষের পালটা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। বাইরের রাজ্যের মন্ত্রীরা বাংলার আবেগ, ভাষা, সংস্কৃতি বোঝেন না। তৃণমূলের এই দাবি ভোটবাক্সেও অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে তাদের।
৪. বাংলার নির্বাচনে এবার বিজেপি কাউকে মুখ করেনি। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীও কেউ ছিলেন না। মূলত নরেন্দ্র মোদির মুখকে সামনে রেখেই চলেছে ভোটপ্রচার। মোদির জনপ্রিয়তা আর ম্যাজিকেই দলের ফল নজরকাড়া হবে বলেই মনে করেছিল গেরুয়া শিবির। কারণ সেই অঙ্কেই লোকসভায় অনেকগুলো আসন নিজেদের দখলে রেখেছিল তারা। কিন্তু বিধানসভা ভোটে সে অঙ্ক খাটেনি। মমতার মুখই কঠিন করে দিল তাদের লড়াই।
৫. বাংলায় বিজেপির স্থানীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য মুখের অভাবও বিজেপির বিপর্যয়ের বড় কারণ। মমতার উলটোদিকে কোনও একটি মুখ রাজ্যবাসীর ভরসার স্তম্ভ হয়ে উঠতে ব্যর্থ। দুর্নীতিতে বিদ্ধ তৃণমূলীদের দলে টানাও বুুমেরাং হয়েছে। তারকাদের নিয়ে দল ভারী করেও বিশেষ লাভ হয়নি। মিঠুন চক্রবর্তীর মতো সুপারস্টারও শেষমেশ বাংলার মানুষের বিরাগভাজন হয়ে দাঁড়ান।
৬. নির্বাচনের আগে টানা পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের দাম বাড়া, দিল্লিতে কৃষক বিক্ষোভের মধ্যে বাংলার কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলাও বিজেপির বিরুদ্ধেই গিয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞ মহলের।
৭. নির্বাচন কমিশন থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী, সিবিআই, ইডি- সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছে কেন্দ্র সরকার। নিজেদের মতো করে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। তৃণমূলের এই দাবিও সাধারণ মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। নির্বাচন চলাকালীন যেভাবে তৃণমূল নেতাদের একাধিক ইস্যুতে তলব করা হয়েছে, তাও কোথাও বিজেপির বিপক্ষে গিয়েছে।
সূত্রের খবর, দলের এই হারে নাকি বেশ অসন্তুষ্ট অমিত শাহ ইতিমধ্যেই রাজ্য বিজেপির কাছে রিপোর্ট তলব করেছেন। পাশাপাশি একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার ভূমিকা নিয়ে নাকি দলের অন্দরেও চাপানউতোর তৈরি হয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.